রাজ্যে ভোটার তালিকার বিশেষ আমূল সংশোধনের (এসআইআর) প্রস্তুতির মধ্যে ফের হুঙ্কার দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গত করলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপনের মঞ্চ থেকে বৃহস্পতিবার বিজেপি ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘সারা ভারত থেকে ৫০০ দল এনে বাড়িবাড়ি সমীক্ষা করছে। কার নাম বাদ দেওয়া যায়। কাউকে কোনও তথ্য দেবেন না। তা হলে নাম কেটে দেবে।’’ সেই সঙ্গে রাজ্যের সরকারি আধিকারিকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে মুখ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘মনে রাখবেন, নির্বাচন কমিশন আসে আর যায়। রাজ্য সরকার থেকে যায়।’’
বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে বুথের সংখ্যা বাড়ানো নিয়ে আজ, শুক্রবার প্রথম সর্বদল বৈঠক ডেকেছেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও)। তার ২৪ ঘণ্টা আগে ধর্মতলার গাঁধীমূর্তির নীচে সমাবেশ থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে তৃণমূল। ভোটার তালিকা নিয়ে নিজের আশঙ্কার কথা জানিয়ে মমতা এ দিন বলেন, ‘‘আধার কার্ড করে রাখুন। আধার গ্রহণ করা হবে। নজর রাখুন। যতই চক্রান্ত করো, কোনও লাভ হবে না। গায়ের জোরে কিছু করতে দেব না।’’ তাঁর আগে একই সুরে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকও বলেছেন, ‘‘এক জনেরও মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে ১০ লক্ষ মানুষ নিয়ে দিল্লিতে যাব আমরা!’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘এত দিন দেশের মানুষ সরকার বেছে নিয়েছে। এখন সরকার মানুষ অর্থাৎ ভোটার বেছে নিতে চাইছে।’’
তৃণমূলের আপত্তি নিয়ে পাল্টা কটাক্ষ করেছে বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পুরো প্যানেলকে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, জানেন তারা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নির্বাচন করবে। এসআইআর হলে তাঁর বিশেষ ভোট চলে যাবে।’’ শুভেন্দুর সংযোজন, ‘‘যে প্রকৃত ভোটার, তার নাম বাদ যাবে কেন! মৃত ভোটার, একাধিক জায়গায় নথিভুক্ত ভোটার, অস্তিত্বহীন ভোটার এবং রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নাম থাকবে না।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘বিধাননগরের পুরভোটের দিনটি ছিল আমার জীবনের অত্যন্ত দুঃখের দিন। কোভিডের সময়ে অল্প দিনের ব্যবধানে আমার মা-বাবা দুজনেই মারা যান। নির্বাচনের দিন ভোট দিয়ে পার্টি অফিসে পৌঁছে জানতে পারি, বিকেল ৪টে নাগাদ তাঁরা এক সঙ্গে ভোট দিয়ে গিয়েছেন! ওই সময় যদি সেখানে থাকতাম, তা হলে তাঁদের সঙ্গে আমার দেখা হত!’’ তাঁর কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূলের মানবিক চাহিদা, যাঁরা প্রয়াত হয়েছেন, তিনিও তো কারও পিতা, কারও মাতা, কারও পরিজন বা প্রেমিক ছিলেন। মারা গিয়েছেন বলে কি তাঁদের নাম বাদ দিতে হবে!’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মতে, ‘‘গত ১২ বছরে জনসংখ্যার নিরিখে ভোটারের সংখ্যা বৃদ্ধির যে জাতীয় হার, এ রাজ্যে সেটা প্রায় ১০% বেশি। মৃত এবং ভূতুড়ে ভোটার থেকে যাওয়াই এর কারণ, অনুপ্রবেশ নিয়ে বিজেপি যা-ই হইচই করুক না কেন। এই মৃত ও ভূতুড়ে ভোটার বাদ দিতেই হবে। প্রান্তিক, গরিব মানুষ যাতে বঞ্চিত না হন, যাতে বাদ না পড়েন, সে দিকে নজর না-দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অসহযোগিতার কথা বলছেন, তাতে ওই মানুষগুলো আরও বিপদে পড়তে পারেন!’’
বিজেপি ও কমিশন তো বটেই, রাজনৈতিক আক্রমণে মমতা এ দিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলিকেও ফের নিশানা করেছেন। শাহের নাম করেই তিনি বলেন, ‘‘অমিতবাবু, আপনার ছেলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। ওখানে হাজার হাজার লক্ষ কোটি টাকা। রাজনীতিতে কিছুই নেই। ওটা পরিবারতন্ত্র নয়!’’ মমতার অভিযোগ, ‘‘নির্বাচন এলেই এজেন্সিগুলির দাপাদাপি বাড়ে। আগে এজেন্সি রাজনীতি করত না।’’ নাম না-করে দেশের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের উদ্দেশে তৃণমূল নেত্রীর মন্তব্য, ‘‘ললিপপ’বাবু, আপনাদের পরিবারের কত জন আইএএস, আইপিএস কাজ করছেন? আপনাদের দুর্নীতির ভাণ্ডারাও কিন্তু আছে। খুলে দেব। সব ফাঁস করে দেব।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘দয়া করে বিজেপির ললিপপ হবেন না। তা হলে দেশের মানুষ ক্ষমা করবে না।’’ সেই সঙ্গেই বলেছেন, ‘‘নিজের পরিবারকে কাজে লাগিয়ে আপনি এখন ললিপপ চালাচ্ছেন আমাদের উপরে। বাচ্চারা ললিপপ খেলে মানায়, বড়রা সেটা কোনও দলের হয়ে খেলে মানায় না। এখন ললিপপ চালাচ্ছেন আমাদের উপরে।” কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে ‘সেলফিশ জায়েন্ট’ ও ‘হাই লেভল ভাইরাস’ বলেও কটাক্ষ করেন মুখ্যমন্ত্রী।
গত বছর ছাত্র সংগঠনের এই সমাবেশের সময় আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় চাপের মধ্যে ছিল তৃণমূল। এ বার ভোটার তালিকা ও বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষায় আপত্তি ও বাঙালিদের উপরে অত্যাচারকে সামনে রেখে পাল্টা চাপ তৈরি করেছেন মমতা। সামগ্রিক রাজনীতির প্রসঙ্গে এ দিন বিজেপি ও তার সঙ্গে বামেদেরও চড়া সুরে আক্রমণ করে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘বিজেপির লজ্জা নেই। আর বামপন্থীরাও নির্লজ্জ!’’ তবে দীর্ঘ বক্তৃতায় এক বারও কংগ্রেসের নাম করেননি তিনি।