আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর প্রখ্যাত কমিউনিস্ট চিন্তাবিদ মহিত সেনকে বলেছিলেন, “কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বলতা বিদেশে ভারতের শত্রুদের কাছে প্রকাশ পেয়ে গেলে তারা সেই সুযোগ কাজে লাগাবে।” আজ সেই সতর্কবাণী আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। কারণ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর প্রধান মোহন ভাগবত সম্প্রতি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা কেন্দ্রীয় শাসকের ভিতকে দুর্বল করে দিচ্ছে, ঠিক তখনই যখন আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারত প্রবল চাপের মুখে।
সম্প্রতি ভাগবত একাধিক ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে কোণঠাসা করে তুলেছেন। প্রথমত, বিজেপির পরবর্তী সভাপতি নিয়োগে আরএসএসের কোনও আপত্তি নেই বলে জানিয়ে তিনি প্রকাশ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, দেরি হওয়ার দায় সম্পূর্ণ মোদী-শাহ জুটির উপরেই বর্তায়। এর ফলে শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বকে অনিশ্চিত ও দুর্বল মনে হয়েছে। যদিও স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লার প্রাচীর থেকে মোদী আরএসএসকে প্রশংসা করে সম্পর্ক মেরামতির চেষ্টা করেছিলেন, ভাগবতের এই অবস্থান তা আবারও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো তাঁর মন্তব্য যে, কাশী-জ্ঞানবাপী মসজিদ এবং মথুরার শাহী ইদগাহ নিয়ে আন্দোলনে সংঘের কর্মীরা যোগ দিতে স্বাধীন। আরও চাঞ্চল্যকরভাবে তিনি বলেছেন, “শুধু তিনটি জায়গা”—অর্থাৎ অযোধ্যা, কাশী ও মথুরা—“অন্যপক্ষ যদি ভাইচারা রক্ষার খাতিরে এগুলো ছেড়ে দেয়।” এ বক্তব্য কার্যত সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজকে চাপে ফেলার চেষ্টা এবং জনমতকে ধর্মীয় মেরুকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করছে।
রাজনৈতিক মহলের মতে, এই ইস্যু নিয়ে আসার পেছনে আসন্ন বিহার নির্বাচনের কৌশল কাজ করছে। এনডিএ-র জমি সরে যাওয়ায় বিভাজনমূলক রাজনীতির মাধ্যমে হিন্দু ভোট একত্রিত করার পরিকল্পনা থাকতে পারে। বিহারের পর পরবর্তী বড় লড়াই উত্তরপ্রদেশে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রায়ই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে পুলিশি দমননীতি ব্যবহার করেন। ২০১৯–২০ সালের সিএএ-বিরোধী আন্দোলন দমন এবং নিম্ন আদালতের শাসকপন্থী অবস্থান শাসকদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে যে, মুসলিম নিম্নবর্গকে তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।
তবে এই ধরনের উসকানি জাতীয় ঐক্যকে বিপন্ন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিদিন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে মোদী সরকারকে। প্রবাসী ভারতীয় লবির প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়ার চেষ্টা চলছে ঠিক সেই সময়েই যখন বেইজিং পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এই অস্থির আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভেতরে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়িয়ে পড়লে ভারতকে দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবেই দেখা হবে। উপসাগরীয় দেশগুলোও আমেরিকার ইঙ্গিতে ভারতের সংখ্যাগুরুবাদী প্রবণতার প্রতি বিরূপ হতে পারে।
শতবর্ষ পূর্ণ করতে চলা সংঘের প্রধান হিসেবে ভাগবতের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতার আশা করেছিলেন বহু দেশপ্রেমিক হিন্দু। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্য কেবল সামাজিক সম্প্রীতিকে আঘাত করেনি, বরং আরএসএসকে নৈতিকভাবে খাটো করেছে। নিরাপত্তা আর বিলাসিতায় ঘেরা সংঘনেতা তাঁর সংগঠনের কট্টর ভাবমূর্তিকে আরও বিতর্কিত করে তুলেছেন। আজ থেকে চার দশক আগে ইন্দিরা গান্ধীর উচ্চারিত “রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্বল হলে শত্রুরা সুযোগ নেবে” সতর্কবার্তা নতুন করে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দেশ যখন ঐক্যবদ্ধভাবে বৈদেশিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তায় রয়েছে, তখন মোহন ভাগবতের এই পদক্ষেপ জাতীয় স্বার্থের পক্ষে বিপজ্জনক বলেই মনে করা হচ্ছে।