• সাপের কামড়ে পক্ষাঘাত হওয়ার পরিস্থিতি! উন্নত চিকিৎসায় ন’বছরের নাবালককে সুস্থ করল কলকাতার হাসপাতাল...
    আজকাল | ৩০ আগস্ট ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: আবারও প্রমাণিত হল চিকিৎসা বিজ্ঞানে শহর কলকাতা অন্যান্য রাজ্যের থেকে এক ধাপ এগিয়ে। আর এই শহর কলকাতাতেই অসাধ্য সাধন হল। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এলো নাবালক। জানা গিয়েছে, নদিয়া জেলার বেথুয়াডহরি এলাকার বাসিন্দা ৯ বছরের এক নাবালক রাতে শৌচকর্মের জন্য বাড়ির বাইরে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে আসার পর থেকেই তাঁর পেটে প্রবল ব্যথা শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ওই এলাকায় সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটায়, চিকিৎসকরা প্রথমেই সাপের কামড়ের আশঙ্কা করেন। নাবালকের পরিবার জানায়, ছেলেটির চোখের পাতা ঝুলে পড়া এবং শরীর ঢিলে হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে।

    ফলে ধীরে ধীরে সে আরও দুর্বল হয়ে পরে। তাঁকে তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় গ্রামীণ হাসপাতালে। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর প্রাথমিক পরীক্ষায় সাপের কামড়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অ্যান্টিভেনম (সাপের বিষের প্রতিষেধক) দেওয়া হয়, কিন্তু অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ওই নাবালককে নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। কিন্তু ভর্তি হওয়ার মত পরিস্থিতি এবং বেড না পাওয়ার কারণে একাধিক হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে গুরুতর অবস্থায় তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন ছেলেটির শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে, এবং তাঁর শ্বাসতন্ত্রের পেশিগুলি প্যারালাইজড হয়ে যাচ্ছিল বলে জানিয়েছেন পিয়ারলেস হাসপাতালে চিকিৎসকরা।

    এরপর তাঁকে তৎক্ষণাৎ পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা শুরু করা হয় এবং ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিম শ্বাস দেওয়া শুরু হয়। নাবালককে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালের শিশু রোগ বিভাগের ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর চিকিৎসক সংযুক্তা দে-এর অধীনে। জানা গিয়েছে, ওই নাবালকের শরীরে দুটি ক্ষুদ্র সাপের কামড়ের চিহ্ন পাওয়া যায়। চিকিৎসকদের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী এটি একটি নিউরোটক্সিক সাপের কামড়, যা একসঙ্গে মায়োটক্সিসিটি-ও সৃষ্টি করে — অর্থাৎ এটি নার্ভ ও মাংসপেশি উভয়কেই আক্রান্ত করে। এই ধরণের সাপের কামড়ে পুরো শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে এবং এটি জীবননাশক হতে পারে বলে জানান, চিকিৎসক সংযুক্তা দে। শুধু তাই নয়, ছেলেটির রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তাঁকে রক্ত ও অন্যান্য উপাদান ট্রান্সফিউশন করতে হয়।

    দেখে নেওয়া যাক নিউরোটক্সিক সাপের কি কি ধরন এবং এ ধরনের সাপ কামড়ালে কি কি হতে পারে, উপসর্গ ও তার চিকিৎসা : 

    স্নায়ুবিষাক্ত সাপের কামড় (Neurotoxic Snakebite) স্নায়ুবিষাক্ত সাপের বিষে উপস্থিত নিউরোটক্সিন স্নায়ুর সংকেত প্রেরণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে পেশীর দুর্বলতা, পক্ষাঘাত (paralysis), এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত এই বিষ স্নায়ু ও পেশীর সংযোগস্থলে (neuromuscular junction) কাজ করে এবং স্নায়ু থেকে পেশীতে সংকেত পৌঁছানো ব্যাহত করে।

    স্নায়ুবিষাক্ত সাপের উদাহরণ: কোবরা, ক্রাইট, মাম্বা, কোরাল স্নেক, কিং কোবরা এবং সমুদ্র সাপ—যেগুলো সবাই Elapidae পরিবারভুক্ত।

    কীভাবে স্নায়ুবিষ কাজ করে?

    * স্নায়ু সংকেতের বাধা (Nerve Impulse Blockade):বিষ স্নায়ু ও পেশীর মধ্যে স্বাভাবিক সংকেত আদানপ্রদান নষ্ট করে দেয়।

    * পেশীর পক্ষাঘাত (Muscle Paralysis):এই বিঘ্নের কারণে পেশীর নিয়ন্ত্রণ হারাতে হয়, যার ফলে দেখা দেয় -

    * চোখের পাতার ঝুলে পড়া (Ptosis)

    * পেশীর দুর্বলতা।

    * ডায়াফ্রাম পক্ষাঘাত, ফলে শ্বাসকষ্ট ও শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া

    * হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বন্ধ হয়ে যাওয়া

    স্নায়ুবিষাক্ত সাপের ধরন:

    ১. কোবরা (Cobra): কিং কোবরা-সহ বিভিন্ন কোবরা প্রজাতি নিউরোটক্সিক বিষের জন্য পরিচিত।

    ২. ক্রাইট (Krait): বিশেষ করে কমন ক্রাইট ভারতীয় উপমহাদেশে নিউরোটক্সিক কামড়ের অন্যতম প্রধান কারণ।

    ২. মাম্বা (Mamba): কালো মাম্বার মতো প্রজাতির সাপের বিষ অত্যন্ত শক্তিশালী, যা একদিকে স্নায়ুবিষাক্ত আবার হৃদবিষাক্ত (cardiotoxic) প্রভাবও রাখে।

    ৩. কোরাল স্নেক (Coral Snake): আমেরিকায় পাওয়া যায়, এবং এদের বিষ নিউরোটক্সিক।

    ৪. সামুদ্রিক সাপ (Sea Snake): বেশিরভাগ সমুদ্র সাপও নিউরোটক্সিক বিষ বহন করে।

    স্নায়ুবিষাক্ত সাপের কামড়ের উপসর্গ

    প্রাথমিক লক্ষণ:

    * পেশীর দুর্বলতা

    * সার্বিক দুর্বলতা

    * কথা বলতে ও গিলতে অসুবিধা

    অগ্রগতি:

    * চোখের পাতার ঝুলে পড়া (Ptosis)

    * ধীরে ধীরে পুরো শরীরে পক্ষাঘাত ছড়িয়ে পড়া

    গুরুতর পরিণতি:

    ১. শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশী অকেজো হয়ে শ্বাসরোধ হওয়া

    ২. হৃদযন্ত্রের পক্ষাঘাত

    ৩. অবশেষে মৃত্যু

     জরুরি চিকিৎসা : 

    স্নায়ুবিষাক্ত সাপের কামড় একটি জরুরি চিকিৎসাগত অবস্থা। দ্রুত অ্যান্টিভেনম (Antivenom) প্রয়োগের মাধ্যমে বিষের প্রভাব প্রতিহত করতে হবে, নইলে প্রাণঘাতী পক্ষাঘাত (life-threatening paralysis) ঘটতে পারে। আজকাল ডট ইনের মুখোমুখি হয়ে চিকিৎসক সংযুক্তা দে বলেন, ‘চিকিৎসা চলাকালীন তাঁকে আবার অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয় এবং শরীরের পেশির শক্তি ফিরিয়ে আনতে অ্যাট্রোপিন ও নিওস্টিগমিন ওষুধের সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।’ ‘অবশেষে, এক অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন পরিস্থিতি পেরিয়ে ছেলেটি ভেন্টিলেটর থেকে নিজে নিজেই শ্বাস নিতে শুরু করে — যা এই ধরনের নিউরোটক্সিক সাপের কামড়ে বিরল একটি ঘটনা।’ এই বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তবে এখনও বলা যাচ্ছে না যে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে, তবে বিপদের আশঙ্কা থেকে কাটিয়ে উঠেছে এই নাবালক। কিছুটা পথ এখনও বাকি। তবে তাঁর এই সুস্থ হয়ে ওঠা চিকিৎসক ও পরিবারের জন্য এক অলৌকিক স্বস্তির বার্তা’, এমনটাই জানিয়েছেন চিকিৎসারত প্রখ্যাত শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
  • Link to this news (আজকাল)