• স্তন রাখতে গেলে দিতে হত ট্যাক্স! মহিলাদের 'স্তন কর' সম্পর্কে অজানা ইতিহাস এই গ্রামে বিস্মিত করবে
    আজকাল | ৩০ আগস্ট ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: কর ব্যবস্থা সাধারণত রাষ্ট্রের উন্নয়নের ভিত্তি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, কখনও কখনও কর ব্যবস্থাই পরিণত হয়েছে অমানবিক অত্যাচারে। দক্ষিণ ভারতের তৎকালীন ত্রাভাঙ্কোর রাজ্যে দুই শতক আগে নিম্নবর্ণের নারীদের উপর চাপানো হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর, অকল্পনীয় কর—“মুলাক্করম” বা স্তনকর।তৎকালীন ত্রাভাঙ্কোরে দলিত সম্প্রদায়, বিশেষ করে এঝাভা ও নাদার জনগোষ্ঠী ভয়ঙ্কর সামাজিক নিপীড়নের শিকার ছিলেন। প্রায় ১১০ রকম কর ধার্য ছিল তাদের জীবনের ক্ষুদ্রতম বিষয়গুলির উপর—জেলেদের জালে কর, পুরুষদের গোঁফে কর, অলংকার পরার কর—এমনকি নারীদের শরীরের উপরও কর। রাজা শ্রীমোহন তিরুনালের আমলে চালু হয় মুলাক্করম।

    নিয়ম অনুযায়ী, নিম্নবর্ণের নারী ব্রাহ্মণ বা রাজপরিবারের সামনে কখনও বক্ষ আবৃত রাখতে পারতেন না। স্তন ঢেকে রাখার অধিকার কেবল উচ্চবর্ণের নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। সাধারণ নারী যদি বক্ষ ঢাকতে চাইতেন, তবে দিতে হতো মুলাক্করম। কর নির্ধারণের জন্য একজন সরকারি কর্মচারী “পার্থিভিয়ার” (Parvatiyaar) আসতেন নারীর বাড়িতে। প্রকাশ্যে তাঁর স্তন টিপে দেখে করের পরিমাণ ধার্য করা হতো। একাধিক ব্যক্তি মিলিত হয়ে নারীর শরীরের আকার-আকৃতি বিচার করতেন। অপমান ও শ্লীলতাহানির এই প্রথা চলত নির্লজ্জভাবে।

    এই নৃশংস প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এক সাধারণ এঝাভা নারী—নাঙ্গেলি। চিরথালা গ্রামের এই মদ সংগ্রাহক মহিলার মনেই ছিল অগ্নিশিখা। কৈশোর থেকেই তিনি মুলাক্করমকে অমানবিক অপমান হিসেবে চিহ্নিত করেন। নাঙ্গেলি প্রকাশ্যে বক্ষ আবৃত করে চলাফেরা শুরু করেন। উচ্চবর্ণীয় পুরুষেরা তাঁকে অপমান করে চিৎকার করত— “লজ্জাহীন! উচ্চবর্ণের নারীদের সমান হতে চাইছ? কাপড় সরাও!” নাঙ্গেলির জবাব ছিল স্পষ্ট— “এ কেমন আইন? যে আইন মানবাধিকারেরই অমর্যাদা করে, আমি সে আইন মানি না!”

    একদিন পার্থিভিয়ার ও তার অনুচরেরা নাঙ্গেলির বাড়িতে পৌঁছায়। তাঁকে আবার কর দিতে বলা হয়। প্রত্যাশা ছিল চালের দানার মতো কর। কিন্তু নাঙ্গেলি তখন এক অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘরে গিয়ে একটি কাঁচি ধার করে নিজের দু’টি স্তন কেটে নিলেন এবং রক্তমাখা দুটি মাংসপিণ্ড কলাপাতায় সাজিয়ে পার্থিভিয়ারের সামনে এনে রাখলেন— “সমস্যা যদি আমার স্তনেই হয়, তবে নাও, এগুলোই আমার কর!” মুহূর্তের মধ্যেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়। স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে নাঙ্গেলির স্বামী চিরুকন্দন ছুটে আসেন। দগ্ধ শোক সহ্য করতে না পেরে তিনি স্ত্রীকে চিতায় শায়িত দেখে নিজেও অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দেন। ইতিহাসে বিরল এই আত্মাহুতিকে অনেকে “উল্টো সতীপ্রথা” বলে অভিহিত করেছেন।

    নাঙ্গেলির আত্মত্যাগে তোলপাড় হয়ে ওঠে ত্রাভাঙ্কোর রাজ্য। নাদার ও এঝাভা সম্প্রদায়ের নারীরা সংগঠিত হয়ে শুরু করেন ঐতিহাসিক বিদ্রোহ—চান্নার বিদ্রোহ বা মারু মারাক্কাল সমরাম। নারীরা একসঙ্গে স্তন ঢেকে রাস্তায় নেমে আসেন। আন্দোলনের চাপে রাজা অবশেষে মুলাক্করম চিরতরে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। নাঙ্গেলির আত্মোৎসর্গ শুধু এক অত্যাচারী করব্যবস্থার অবসান ঘটায়নি, বরং নারীমুক্তি ও সামাজিক সমতার এক মাইলফলক রচনা করেছে। আজও কেরলের ইতিহাসে তিনি এক নারী-শক্তির প্রতীক, প্রকৃত নারীবাদীর প্রতিচ্ছবি এবং দমন-অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক অমর নাম। নাঙ্গেলির এই আত্মবলিদান আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানবাধিকার কখনও কারও দান নয়, তা কেবল সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
  • Link to this news (আজকাল)