এসপ্ল্যানেড-শিয়ালদহ আর নোয়াপাড়া-বিমানবন্দর জুড়ে যেতেই ‘দুয়োরানি’! উল্টে বাড়তি চাপে ন্যুব্জ পুরাতন মেট্রোপথ
আনন্দবাজার | ৩০ আগস্ট ২০২৫
তিন সময়ের তিনটি ছবি। তিন ছবিতে একটিই চরিত্র। দুয়োরানি। পোশাকি নাম ‘ব্লু লাইন’।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫১ মিনিট: অফিস থেকে হেঁটে চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনে পৌঁছেছিলেন বেলগাছিয়ার বাসিন্দা দীপ্তি মৈত্র। দিনের শেষে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু পর পর আটটি ট্রেন ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। তার আগের ট্রেনগুলির আসন্নপ্রসবার অবস্থা। ৭টা ৫৮ মিনিটে যে মেট্রোটিতে শেষ পর্যন্ত ঠেলেঠুলে উঠলেন, সেটিও চাঁদনি চকে দাঁড়িয়ে রইল টানা ১৩ মিনিট। কারণ, শোভাবাজার স্টেশনে একটি রেকের দরজা বন্ধ হচ্ছিল না। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে দরজা বন্ধ করার নানা চেষ্টার পর যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। পর পর ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন স্টেশনে। দীপ্তির ভিড়ঠাসা মেট্রোর চাঁদনি চক থেকে বেলগাছিয়া পৌঁছোনোর কথা ছিল ১৩ মিনিটে। লাগল ৩৭ মিনিট! কাহিনি তখনও শেষ হয়নি। ট্রেনটির যাওয়ার কথা ছিল দক্ষিণেশ্বর। কিন্তু শ্যামবাজার থেকে ঘোষণা হল, ট্রেনটি যাবে দমদম পর্যন্ত। সেটিই ‘প্রান্তিক’ স্টেশন। যাত্রীদের সকলকে নামতে হবে সেখানেই।
শুক্রবার সকাল ১১টা ৩৪ মিনিট: শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে সেন্ট্রাল আসবেন বলে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছেছিলেন পাটুলির বাসিন্দা নিমাই সেন। কয়েক সেকেন্ড আগেই দমদমমুখী ট্রেন ছেড়ে গেল। ডিসপ্লে বোর্ডে দেখাচ্ছে, পরের ট্রেন ১১টা ৪০ মিনিটে। কিন্তু সেই ট্রেন এল ১১টা ৫৯ মিনিটে। ১৯ মিনিট দেরি কেন? কে জানে! কোনও ঘোষণা হয়নি। ১৯ মিনিট দেরিতে ছাড়া মেট্রো আরও ১০ মিনিট লেট করে পৌঁছল সেন্ট্রাল। তবে ট্রেনে খুব ভিড় ছিল না। সেটাই বাঁচোয়া!
শুক্রবার দুপুর ১টা ৪ মিনিট: দমদম থেকে মেট্রো ধরে রবীন্দ্র সদনের কাছের অফিসে যাবেন সোদপুরের বাসিন্দা তূর্ণা রায়চৌধুরী। দু’মিনিট পরেই মেট্রোর আসার কথা। সেই ট্রেন দমদমে এল ১টা ১২ মিনিটে। ভিড়ের চোটে দরজার কাছ থেকে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে হল তূর্ণাকে। পরের ট্রেন এল ১টা ২৬ মিনিটে। তাতে উঠেও নামতে হল। কারণ, এসি কাজ করছে না। পরের ট্রেনে ওঠা গেল ভিড় ঠেলে। কিন্তু ১টা ৩২ মিনিটে আসা সেই মেট্রোর দরজা বন্ধ করা নিয়ে সমস্যা। শেষে বন্ধ হল দরজা। কিন্তু মেট্রো চলল ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে। ৩৭ মিনিট পরে তূর্ণা নেমে যান এসপ্ল্যানেডে। ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। প্ল্যাটফর্মের হাওয়ায় কিছুটা জিরিয়ে আবার মেট্রো ধরে রবীন্দ্র সদনে।
কলকাতার প্রাচীনতম মেট্রোপথ ‘ব্লু লাইন’ একদা সত্যিই নীল রক্তধারী ছিল। কারণ, তার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কিন্তু গত শুক্রবার নতুন তিন পথ চালু হওয়ার পর থেকে ব্লু লাইন দুয়োরানি। অনেক বেশি ঝাঁ-চকচকে এবং মসৃণ যাতায়াত ইয়েলো লাইন (নোয়াপাড়া থেকে জয় হিন্দ বিমানবন্দর) এবং গ্রিন লাইনে (সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে হাওড়া ময়দান)। যারা এখন নতুন। ফলে ‘সুয়োরানি’!
কেন এমন হাল ব্লু লাইনের
দক্ষিণেশ্বর থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত ৩২.১৩ কিলোমিটার লম্বা এই পথেই কিছু দিন আগে পর্যন্ত শুধু চলত মেট্রো। এখন সেখানে উপনদীর মতো মিশেছে গ্রিন, ইয়েলো এবং অরেঞ্জ লাইন (কবি সুভাষ থেকে বিমানবন্দর)। গত শুক্রবার গ্রিন লাইনের এসপ্ল্যানেড-শিয়ালদহ অংশ, ইয়েলো লাইন এবং অরেঞ্জ লাইনের হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে বেলেঘাটা পর্যন্ত পথ উদ্বোধন করে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সব পথ এসে যেহেতু কোথাও না কোথাও ব্লু লাইনে মিশেছে, তাই ভিড় বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে প্রতি দিন গড়ে সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ যাতায়াত করেছেন ব্লু লাইনে।
ব্লু লাইনের কবি সুভাষ স্টেশন বন্ধ না থাকলে ভিড় আরও বাড়ত। যদিও কবি সুভাষ নিয়েও বিড়ম্বনায় মেট্রো কর্তৃপক্ষ। কারণ, এখন ব্লু লাইনে মেট্রো দক্ষিণেশ্বর থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম পর্যন্ত চলছে। সেটাই সমস্যা। কারণ, সেখানে ডাউন মেট্রোর রেককে আপ লাইনে নিয়ে আসার কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে ফাঁকা রেক নিয়ে যেতে হচ্ছে কবি সুভাষ পর্যন্ত। সেখান থেকে ‘টার্ন আউট’ করে আবার প্রান্তিক স্টেশন শহিদ ক্ষুদিরাম। তাতে ঘেঁটে গিয়েছে সময়সূচি। এর পরে মেট্রো কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন, সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একটি মেট্রো শহিদ ক্ষুদিরাম যাবে। পরেরটি মহানায়ক উত্তম কুমার (টালিগঞ্জ) থেকে ফিরে যাবে দক্ষিণেশ্বর। কিন্তু যাত্রাপথ কেটেছেঁটেও পরিষেবা সামলাতে পারেনি মেট্রো। এ সবের সঙ্গে জুড়েছে নতুন মেট্রোর চাপ। এসপ্ল্যানেড এবং শিয়ালদহ জুড়ে যাওয়ার পর সেই দিন সন্ধ্যা থেকেই গ্রিন লাইনে পুরোপথে মেট্রো চলাচল শুরু হয়। প্রচুর যাত্রী হাওড়া থেকে এসে এসপ্ল্যানেডে নেমে ব্লু লাইনের মেট্রো ধরতে থাকেন। আবার সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে শিয়ালদহ হয়েও প্রচুর মানুষ নামছেন এসপ্ল্যানেডে। গ্রিন লাইনের সেই ভিড় সামলানোর মতো পরিকাঠামো মেট্রোর ছিল না।
তার সঙ্গে গত সোমবার জুড়েছে বিমানবন্দর-নোয়াপাড়া। ফলে ব্লু লাইনে চাপ আরও বেড়েছে। যাত্রীদের অভিযোগ, পুরনো ব্লু লাইনই সামলাতে পারছিলেন না মেট্রো কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রীর সফরের তোড়জোড় এবং নতুন দুই মেট্রোর পথে নজর দিতে গিয়ে ব্লু লাইনে কোনও নজর দিতে পারেননি মেট্রো কর্তৃপক্ষ। নতুন যা রেক এসেছে, প্রায় সবই ব্যবহার করা হচ্ছে ইয়েলো লাইনে। গ্রিন লাইনের মেট্রো ব্লু লাইনে চালানোর কোনও অবকাশ নেই। নাগেরবাজারের বাসিন্দা মেট্রোর নিত্যযাত্রী রথীকান্ত সেনগুপ্তের কথায়, ‘‘আগে সময়ানুবর্তিতাই ছিল মেট্রোর মূলধন। গত কয়েক বছরে সে সব ঘুচে গিয়েছে। এখন আসি যাই মেট্রো পাই— এমন একটা অবস্থা। কোনও সময় নেই। অর্ধেক ট্রেনে এসি চলে না। দরজা বেশির ভাগ সময় বন্ধ হয় না। তার উপর লাইনে ঝাঁপ দেওয়া রয়েছেই। কখন যে বন্ধ হয়ে যাবে তার ঠিক নেই। মাঝপথে নেমে বাদুড়ঝোলা বাসে ফেরা! গত এক সপ্তাহে হাল আরও বেহাল হয়েছে।’’ দত্তপুকুরের বাসিন্দা মল্লিকা দত্ত অবশ্য বলছেন, ‘‘মেট্রোকে দোষ দিয়ে কী লাভ? পাঁচ টাকায় এই লাইনে এসি ট্রেন চড়াচ্ছে! অন্যান্য শহরে বা অন্য মেট্রোয় তো ভাড়া এর চেয়ে বেশি। তাই ভিড় বাড়লেও কর্তৃপক্ষও হয়তো গুরুত্ব দিতে চান না। ভাড়া বাড়ালে যদি পরিস্থিতি একটু সহনীয় হয়!’’
মেট্রোর এক কর্তার সাফাই, ‘‘৪০ বছর ধরে ব্লু লাইন পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে। গোটা দেশে আর কোথাও এমন নেই। এত দিন ধরে চললে কিছু সমস্যা তো থাকবেই। আমরা চেষ্টা করছি, সে সব সমস্যা কাটিয়ে ঠিকঠাক পরিষেবা দিতে। রবিবার শহিদ ক্ষুদিরামে একটা টার্ন আউট বসানো হবে। তার পর সমস্যা আর থাকবে না বলেই আশা করছি। এটা সাময়িক ব্যাপার। শীঘ্রই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’’
ভিড়ে লক্ষ্মীলাভ
ভিড় যেমন বেড়েছে, তেমন আয়ও বেড়েছে মেট্রোর। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের আগের দিন, অর্থাৎ ২১ অগস্ট বৃহস্পতিবার মেট্রোর আয় হয়েছে ৯০ লাখ ২২ হাজার ৯১৬ টাকা। সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে, অর্থাৎ গত বুধবার ২৭ অগস্ট সেটাই বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ২৩ লাখ ১ হাজার ৬৪৯ টাকা! দিনের হিসাবে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা বেশি। সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে ২৫ অগস্ট। সে দিন সব লাইন মিলিয়ে আয় হয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ ৮৬ হাজার ৯৮৬ টাকা। যাত্রীসংখ্যাও বেড়েছে। মেট্রোর প্রিন্সিপাল চিফ অপারেশন ম্যানেজার লখেশ্বর শইকিয়ার কথায়, ‘‘গত ২১ তারিখে আমাদের যাত্রীসংখ্যা সব লাইন মিলিয়ে ছিল ৬ লাখ ২৪ হাজার ৫৩৯। সেটা বেড়ে ২৭ তারিখে হয়েছে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮১। এর মধ্যে ব্লু লাইনেই বেড়েছে গড়ে প্রায় ৫০ হাজার যাত্রী। গ্রিন লাইনে কোনও কোনও দিন ১ লাখ যাত্রী বেশি হয়েছে আগের চেয়ে।’’ তবে পাশাপাশিই তাঁর সংযোজন, ‘‘আয়ের দিক থেকে ব্লু লাইনই আমাদের লক্ষ্মী। সেখান থেকেই সবচেয়ে বেশি আয় হয়। দৈনিক প্রায় ১ কোটি টাকা। আসলে নতুন লাইন সংযোজন হলে প্রথম দিকে ভিড় একটু বেশি হয়। অনেকে উৎসাহ নিয়ে নতুন রুট দেখতে চান।’’ আবার অন্য এক মেট্রোর কর্তার কথায়, ‘‘আমরা ভবিষ্যৎ হিসাবে গ্রিন লাইনকেই দেখছি। গোটা দেশের মধ্যে দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকবে ব্লু লাইন। এত পুরনো পরিষেবা গোটা দেশে কোথাও নেই।’’
ভিড় সামলাতে বেসামাল
আয় হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সেই অনুপাতে পরিষেবা বাড়েনি ব্লু লাইনে। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঠিকঠাক ঘোষণা হয় না। সময়ে মেট্রো চলে না। এসি খারাপ থাকে অনেক রেকে। দরজা বন্ধ হয় না। এমন হাজারো অভিযোগ। মেট্রোর কি অনুমান ছিল না যে, নতুন রুট চালু হয়ে ব্লু লাইনের সঙ্গে জুড়লে ব্লু লাইনে ভিড় বাড়বে? তখন যাত্রী পরিষেবা শিকেয় উঠতে পারে? সেই প্রস্তুতি কেন নেওয়া হয়নি? মেট্রো রেলের জেনারেল ম্যানেজার পি উদয় কুমার রেড্ডির বক্তব্য, ‘‘আমরা ৫ মিনিট অন্তর পরিষেবা চালাচ্ছি। এখন ব্লু লাইনে ২৮৪টি পরিষেবা রয়েছে। ওই লাইনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই দেখা হয়। কোথাও কোনও সমস্যা হলেই আমাদের কর্মীরা যত দ্রুত সম্ভব ঝাঁপিয়ে পড়েন। যাত্রীদের সমস্যা থাকার কারণ নেই।’’
মেট্রোকর্তারা যদি এক বার বাগদাদের বাদশা হারুন অল রশিদের মতো ছদ্মবেশে দুয়োরানির সংসারে উঁকি দিতেন!