পা টেনে টেনে ফ্লোরে যাচ্ছেন বেণু আন্টি, না দেখেই সকলে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন! ওঁকে দেখে শিক্ষা নিয়েছি
আনন্দবাজার | ৩০ আগস্ট ২০২৫
শ্রীলেখা মিত্র
দিনকাল বড্ড ঘোরালো। তালিকায় নাম লেখাতে হবে। সেটা অভিনয় দুনিয়া বলুন বা অন্য পেশা। তা হলেই আপনি আছেন। না হলে নেই! যেমন আমি। এত গুলো বছর কাটিয়ে ফেললাম। চুলে পাক ধরেছে। শরীরে বলিরেখার থাবা। তবু অঙ্ক কষে চলতে পারলাম কই? আজও তালিকায় নাম লেখাতে পারিনি। তাই কাজ পাই না। কাজ পেতে গেলে তালিকায় নাম থাকাটা জরুরি! আমি, আমার বাড়ির প্রত্যেকে গোটা জীবন আবেগের বশে কাটিয়ে দিলাম। সুখ না পেলেও শান্তিতে আছি।
আমার কি তাতে দুঃখ হচ্ছে? যেমন, জন্মদিনে বয়স বাড়লে দুঃখ হয়। মনের মতো কাজ না পেলে দুঃখ হয়। অতীত মনে পড়লে দুঃখ হয়। এ সব নিয়ে আমার দুঃখ নেই। আমার ব্যথা মা-বাবাকে হারানোর। বাবা রাত ১২টায় ভরাট গলায় ‘হ্যাপি বার্থডে টুম্পা’ গেয়ে ফোন করত। মা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বলত, ‘ভাল থাকিস সোনামণি’। এ সব করার কেউ নেই। মেয়ে অবশ্য বেঙ্গালুরু থেকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। গৃহসহায়িকা নিজেই দুধ, চাল কিনে এনে পায়েস বানাচ্ছেন। আর আমার চারপেয়ে ছানাপোনারা আছে। আজ ওদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাব।
আর একটা যন্ত্রণা, ‘টুম্পা’কে হারিয়ে ফেলেছি। বাবার চোখের মণি ওই মেয়েটি খুব সরল ছিল। প্রাণ খুলে হাসত। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সেই হাসি, সারল্য মুছে দিয়েছে। খুব আফসোস হয়। সেই দিন গুলোকে আর ফিরে পাব না। গলার কাছটা ব্যথা করে। এই জন্যই মেয়েটির চওড়া হাসি বহু দিন ‘নিখোঁজ’!
না, বয়স নিয়ে আমার কোনও অস্বস্তি নেই। বয়স আমার কাছে সংখ্যা। আমিই বোধহয় একমাত্র অভিনেত্রী যে, বয়স লুকোয় না। আমার বয়স বাড়ে। সেটা উদ্যাপন করি।
আর উদ্যাপন করি আমার জীবনবোধকে। হয়তো কোনও দিন অঙ্ক কষিনি। কিন্তু বেহিসাবিও নই। যখন যা উপার্জন করেছি, জমিয়েছি। কোনও দিন লোকদেখানো কিচ্ছু করিনি। তাই কাজ না থাকলেও ভেসে যাইনি। এই শিক্ষা কাকে দেখে পেয়েছি, জানেন? বেণু আন্টি মানে সুপ্রিয়া দেবীকে দেখে। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র ‘নীতা’ আমার খুব প্রিয়। বেশি বয়সে উপার্জনের জন্য বেণু আন্টি ধারাবাহিকে অভিনয় করতেন। পা টেনে টেনে স্টুডিয়ো ফ্লোরে যেতেন। চার পাশ দিয়ে কত জন হেঁটে যাচ্ছেন। কেউ তাঁকে পাত্তাই দিচ্ছেন না! দেখে খুব খারাপ লেগেছিল।
ওই দিন শপথ নিয়েছিলাম, উপার্জিত অর্থ অকারণে খরচ করব না। যাতে বেশি বয়েসে কাজ না পেলেও আমার চলে যাবে।
আরও একটা জিনিস করেছি। কোনও দিন মিথ্যা বলিনি। কারও ক্ষতি করিনি। আমার মতো শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলতে ক’জন পারে? সেই জায়গা থেকে বলছি, শ্রীলেখা মিত্র ফুরিয়ে যায়নি। এত সহজে ফুরিয়ে যাওয়ার মেয়ে সে নয়। আমি আবার ফিরে আসব। ফিরব ঠিক আগের মতো করে।