১০ বছর বয়সেই স্তনের আকার প্রকাণ্ড! বাঁকা চোখে তাকাত পাড়াপড়শিরা, অসাধ্য সাধন করলেন চিকিৎসকরা ...
আজকাল | ৩০ আগস্ট ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা সম্প্রতি এক নয়, দুটি অত্যন্ত বিরল রোগে আক্রান্ত রোগীর জীবন রক্ষা করলেন। চিকিৎসক মহলের মতে, এই ধরনের জটিল অস্ত্রোপচার বিশ্বমানের সাফল্যের উদাহরণ। মাত্র ১০ বছরের এক কন্যা শিশুর শরীরে শুরু হয়েছিল অস্বাভাবিক পরিবর্তন। স্তনের আকার অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকায় তাকে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। চিকিৎসকদের ভাষায়, রোগটির নাম ‘জাইগান্টোমাস্টিয়া’। সাধারণত ১৮ বছর বা তার ঊর্ধ্ব বয়সী ঋতুমতী মেয়েদের ক্ষেত্রে এই রোগ দেখা গেলেও, এত কম বয়সে তা হওয়া অত্যন্ত বিরল।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২১ সাল থেকে ওই নাবালিকার স্তনের বৃদ্ধি শুরু হয়েছিল। তখনও তার ঋতুচক্র শুরু হয়নি। আকার অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় স্কুলে সহপাঠীদের কাছে তাকে অস্বস্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। এমনকি রাস্তাঘাটে ও প্রতিবেশী মহলেও চরম অসুবিধায় পড়ছিলেন অভিভাবকরা। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল নাবালিকার পিঠের তীব্র যন্ত্রণা। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখতে পান, তার বাঁ দিকের স্তনে একটি টিউমার রয়েছে। ব্রেস্ট অ্যান্ড এন্ডোক্রিন সার্জারি ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ দল অপারেশনের মাধ্যমে টিউমারটি বাদ দেন। অস্ত্রোপচারের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে নাবালিকা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশুদের ক্ষেত্রে এই ধরনের কেস অত্যন্ত বিরল এবং চিকিৎসা-প্রতিবেদন হিসেবে এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
অন্যদিকে, হুগলির রিষড়ার বাসিন্দা ৪২ বছর বয়সী পার্বতী ধারা-র শরীরে ধরা পড়ে একটি বিরল টিউমার। তাঁর অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে গজিয়েছিল ফেওক্রোমোসাইটোমা (Pheochromocytoma) নামের মারাত্মক টিউমার। সাধারণত এক মিলিয়ন মানুষের মধ্যে দু’ থেকে আটজনের শরীরে এ ধরনের টিউমার দেখা যায়। কিন্তু পার্বতী ধারার টিউমারটি ছিল অতিরিক্ত বিরল ও বিপজ্জনক আকারের। অস্ত্রোপচারে বাদ দেওয়া টিউমারের দৈর্ঘ্য ২৫ সেমি × ২০ সেমি × ১০ সেমি এবং ওজন প্রায় ৩.৫ কেজি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ৭ সেমি-এর চেয়ে বড় ফেওক্রোমোসাইটোমা-কে বলা হয় ‘জায়ান্ট ফেওক্রোমোসাইটোমা’। এ ধরনের টিউমারকে বিশেষজ্ঞরা বলেন “বায়োলজিকাল টাইম বোমা”, কারণ যেকোনও সময় হঠাৎ মৃত্যু ঘটাতে পারে। রোগটির প্রাথমিক লক্ষণ মাথাব্যথা, ঘাম, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং রক্তচাপ ওঠানামা।
এই জটিল অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেন ড. ধৃতিমান মৈত্র (অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ব্রেস্ট অ্যান্ড এন্ডোক্রিন সার্জারি সার্ভিসেস, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ)। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ড. অনিমেষ মাইতি, ড. রানা ভট্টাচার্য, ড. পার্থ প্রতম চক্রবর্তী, ড. নীতি আগরওয়াল প্রমুখ। টিমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আরও কয়েকজন সার্জন—ড. উত্তম মণ্ডল, ড. অর্ণেশ বিশ্বাস, ড. অদ্রিজা বসাক, ড. প্রদীপ মণ্ডল। অপারেশনের সময় অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবস্থাপনা ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ টিউমারটি রক্তচাপকে অত্যন্ত বিপজ্জনক মাত্রায় ওঠানামা করাচ্ছিল। অ্যানেস্থেসিয়া টিমের নেতৃত্ব দেন ড. হর্ষপ্রভা দত্ত এবং ড. গার্গী ভদ্র দাশগুপ্ত। তাঁদের দক্ষতায় অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
অস্ত্রোপচারের পর রোগিণীর অবস্থা স্থিতিশীল। চিকিৎসকদের মতে, উচ্চ রক্তচাপের প্রতি ১০০ জন রোগীর মধ্যে একজনের শরীরে লুকিয়ে থাকতে পারে ফেওক্রোমোসাইটোমা। এটি হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমে হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা হঠাৎ হৃদ্যন্ত্র বিকল করার আশঙ্কা তৈরি করে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, একদিকে অতি বিরল শিশুদের জাইগান্টোমাস্টিয়া কেস এবং অন্যদিকে বিশ্বে মাত্র কয়েকটি নথিভুক্ত জায়ান্ট ফেওক্রোমোসাইটোমার সফল অস্ত্রোপচার—দুটিই এই হাসপাতালের চিকিৎসা দক্ষতার প্রমাণ। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এই সাফল্য শুধু বাংলার নয়, গোটা দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য এক বড় প্রাপ্তি।