• স্কুলে মুসলিম পড়ুয়াদের ভর্তি করা যাবে না! নয়া ফতোয়া গুজরাটে 
    আজকাল | ৩১ আগস্ট ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: আহমেদাবাদের একটি স্কুল প্রাঙ্গণে ঘটে যাওয়া ছুরি দিয়ে আঘাতের ঘটনাকে ঘিরে গোটা রাজ্যে উদ্বেগজনক মাত্রায় বাড়ছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রবণতা। ১৯ আগস্ট শহরের মণিনগর এলাকার সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ক্লাস দশের এক ছাত্রকে তারই সহপাঠী ছুরি দিয়ে আঘাত করে গুরুতর আহত করে। হামলার সঙ্গে যুক্ত দুই ছাত্রের মধ্যে একজন হিন্দু ও অন্যজন মুসলিম হওয়ায়, মুহূর্তের মধ্যেই ঘটনাটিকে ধর্মীয় রঙ দিতে শুরু করে রাজ্যের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো।

    পরদিনই বাজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা শতাধিক মানুষকে জড়ো করে স্কুলের বাইরে বিক্ষোভ দেখায়। বিক্ষোভ দ্রুতই ভাঙচুর ও বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন অনেক অভিভাবকও, যারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে দাবি করতে থাকেন যে, স্কুলে যেন আর কোনও  মুসলিম ছাত্রকে ভর্তি না নেওয়া হয়। এই আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, স্কুল কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় সব মুসলিম ছাত্রকে ‘স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট’ বা ছাড়পত্র দিয়ে বিদায় করতে।

    ঘটনাটি একেবারেই বিচ্ছিন্ন নয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গোটা গুজরাট জুড়ে স্কুলের ভেতরে ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি থেকে শুরু করে খেলাধুলার সময়ের সংঘর্ষকেও পদ্ধতিগতভাবে সাম্প্রদায়িক রঙে রাঙিয়ে তুলছে ডানপন্থী সংগঠনগুলো। ছাত্রদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে “হিন্দু বনাম মুসলিম” সংঘাত হিসেবে দেখিয়ে রাজ্য জুড়ে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ শৃঙ্খলাজনিত সমস্যাগুলি আড়াল হয়ে যাচ্ছে, আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের চিহ্নিত করে আক্রমণের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।

    ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও রাজনৈতিক কর্মী বিপিনভাই গাধভি বলেন, স্কুল প্রাঙ্গণের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি দেখেছেন কীভাবে আন্দোলনকারীরা উন্মত্তভাবে চিৎকার করে বলছিল—“এই স্কুল পুড়িয়ে দাও, শিক্ষকদেরও পুড়িয়ে দাও, সব তাদের দোষ।” গাধভির অভিযোগ, পুলিশ তখন নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়েছিল, কার্যত কোনো হস্তক্ষেপই করেনি।

    মণিনগরের ঘটনার মাত্র দুই দিন পর, ২১ আগস্ট, আহমেদাবাদ থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে ভাদালির শেঠ সি. জে. হাই স্কুলে আরেকটি অনুরূপ ঘটনা ঘটে। সেখানে দুই ছাত্রের মধ্যে হাতাহাতি হয়, একজন হিন্দু ছাত্রের মুখে আঁচড় লাগে। এখানেও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে আন্দোলনে নামে। স্কুল প্রাঙ্গণে গিয়ে উত্তেজনা ছড়ানো হয় এবং কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়া হয় যাতে সব মুসলিম ছাত্রকে স্কুল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে বিদায় করা হয়। শুধু তাই নয়, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, এবিভিপি, আন্তর্জাতিক বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, জাতীয় বাজরং দল সহ একাধিক সংগঠন ভাদালিতে বনধ ডাকে, রাস্তায় নেমে মিছিল করে।

    এই ধরনের ঘটনার পরিণতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। একদিকে শিশুরা নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক চরিত্রে রূপান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হচ্ছে আদর্শগত সংঘাতের মঞ্চে। ভুক্তভোগী ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত ক্ষতি, মানসিক আঘাত এবং শিক্ষাজীবনের বিঘ্ন—সবই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির আওয়াজে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতার বদলে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ভয় এবং বঞ্চনার সংস্কৃতি।

    ভাদালির একই স্কুলে চলতি বছরের জানুয়ারিতে আরও এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছিল। ক্লাস ১১-র এক মুসলিম ছাত্রকে দুইজন হিন্দু শিক্ষক নির্মমভাবে মারধর করে, এমনকি ছাত্রটি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। পরিবার অভিযোগ করেছিল, স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনও  দায়িত্ব নেয়নি। সেই ছাত্র এখনো মানসিক আঘাতের শিকার এবং পরীক্ষায় বসার সুযোগও পাচ্ছে না। পরিবার জানিয়েছে, ওই একই স্কুলে তাদের আরও কয়েকজন সন্তান পড়াশোনা করে, যারা প্রতিদিনই শিক্ষকদের কাছ থেকে অপমানজনক মন্তব্যের শিকার হচ্ছে।

    সামাজিক কর্মী ও আইনজীবী হোজেফা উজ্জয়নি বলেন, এই ঘটনাগুলি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর কারণ এগুলি শিশুদের পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তাঁর মতে, যখন ভিড় স্কুলে গিয়ে ভাঙচুর করে এবং পুলিশ নীরব থাকে, তখন কার্যত শিশুদের বিভাজনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর ফলে সমাজে বাকি যে সামান্য যোগাযোগ ও সহাবস্থান বাকি ছিল, সেটিও ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

    এই প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে এখন নতুনভাবে নিশানা করছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। স্কুল ও কলেজ সমাজীকরণের প্রধান ক্ষেত্র, আর তাই সেগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা তাদের সাংস্কৃতিক প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। বিশেষত সংখ্যালঘু পরিচালিত প্রতিষ্ঠান যেমন মণিনগরের খ্রিস্টান স্কুল, তারা দ্বিগুণভাবে আক্রমণের মুখে পড়ছে—একদিকে মুসলিম বিরোধী উস্কানি, অন্যদিকে খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠানবিরোধী বিদ্বেষ।

    প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বক্তৃতায়ও এই মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে। আহমেদাবাদের এক সভায় তিনি বলেন, “যারা আমাদের উৎসবে রক্ত ঝরায়, ঘুড়ি উড়িয়েও সমস্যা সৃষ্টি করে, তারাই দেশে অশান্তি ছড়ায়।” যদিও এর পক্ষে কোনও  ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, মোদি মুসলিমদের স্থায়ী বিশৃঙ্খলার উৎস হিসেবে উপস্থাপন করে আসছেন। এই ধরনের বক্তব্য কার্যত স্কুল স্তরের ঘটনাগুলিকে সাম্প্রদায়িক করে তোলার পথে বৈধতা দেয়।

    ঘটনার পর মণিনগরের স্কুল ঘিরে আন্দোলনে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন হিন্দুত্ববাদী নেতা প্রকাশ্যে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখেন। এক মহামণ্ডলেশ্বর প্রকাশ্যে তরবারি হাতে জনসভা করে প্রতিশোধের ডাক দেন, অন্যদিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা ধর্মেন্দ্র ভাওয়ানি ঘটনাটিকে “ইসলামি ষড়যন্ত্র” বলে অভিহিত করেন।

    এদিকে এনসিইআরটি ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে জরুরি অধ্যায়, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাট দাঙ্গা ইত্যাদি মুছে দিয়ে মুসলিমদের বাইরের লোক হিসেবে দেখানোর যে প্রবণতা শুরু করেছে, সেটিও শিক্ষাঙ্গনের এই বিপজ্জনক পরিবর্তনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। পাঠ্যপুস্তকে একতরফা ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা ছোটখাটো ঝগড়াকেও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করে।

    গোয়া-তে এনসিইআরটির এক সমীক্ষা বলছে, প্রায় এক-চতুর্থাংশ স্কুলে এখনো কোনও  অ্যান্টি-বুলিং নীতি নেই, আর এক-তৃতীয়াংশ শিশু জানিয়েছে তারা সহপাঠীর হাতে শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এই বাস্তবতায় স্কুলশিক্ষার প্রধান চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত শিশুদের নিরাপত্তা ও সহনশীলতা শেখানো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সেটিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে গিয়ে সংখ্যালঘুদের বঞ্চনা ও ঘৃণার স্বাভাবিকীকরণ ঘটাচ্ছে।

    এই পরিস্থিতি স্পষ্টতই ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক, অবিশ্বাস এবং ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, আর একইসঙ্গে স্কুলগুলো সামাজিক বিভাজনের নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে।
  • Link to this news (আজকাল)