আজকাল ওয়েবডেস্ক: অসমে বিজেপি শাসনের অধীনে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা প্রকাশ্যেই সংবিধানের ঊর্ধ্বে থাকার দাবি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে, একদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ অভিযান চলছে সমান্তরালভাবে। সমালোচকদের মতে, এটাই আজকের “অসম মডেল”—প্রথমে সত্য বলার অধিকারকে দমন, পরে অসহায় জনগোষ্ঠীর জীবন ভেঙে দেওয়া।
গত মে মাসে বিজেপির অন্তত দুই সদস্য-সহ তিন অভিযোগকারীর আবেদনের ভিত্তিতে অসম পুলিশ দ্য ওয়্যার-এর সম্পাদক সিদ্দার্থ বরদারাজন এবং প্রবীণ সাংবাদিক করণ থাপারের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে। অভিযোগ—“অশান্তি সৃষ্টি, জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ ও শত্রুভাবাপন্ন বয়ান প্রচার।” কিন্তু বাস্তবে তারা কেবল রাজ্যের প্রশাসনিক ও সাম্প্রদায়িক প্রবণতা নিয়ে বিশ্লেষণ করছিলেন। তবে এফআইআর সাংবাদিকদের হাতে পৌঁছয় ১২ আগস্ট। তখনই ইউটিউবার-সাংবাদিক অভিষার শর্মার নামও যোগ করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট বরদারাজন ও থাপারকে সুরক্ষা দিলেও অভিষার শর্মাকে শুধু চার সপ্তাহের অন্তর্বর্তী রেহাই দিয়ে অসম হাইকোর্টে যেতে বলা হয়েছে। প্রাক্তন বিচারপতি মদন বি. লোকুর মন্তব্য করেছেন—“অসম পুলিশ সাংবাদিকদের হয়রানি করছে, অস্তিত্বহীন অপরাধে প্রক্রিয়াটাকেই শাস্তিতে পরিণত করছে।”
একই সময়ে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। নিশানায় তথাকথিত ‘মিয়াঁ’ সম্প্রদায়—যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করলেও “বিদেশি” বা “অনুপ্রবেশকারী” তকমা পাচ্ছেন। ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই বুলডোজার নামিয়ে ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি সরকারি জমিতে আশ্রয় নিলে আরও বেশি বিপন্ন হয়ে পড়ছেন। জুন-জুলাই মাসেই অন্তত ৩,৩০০ পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে। অনেককে সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশ ফেরত পাঠালে তারা আটকে পড়ছে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’-এ। একদিকে দরিদ্র মুসলিমদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় আদিবাসীদের জমি কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, কোথাও টাউনশিপ, ফুড পার্ক বা তেলবীজ চাষ—আদানি থেকে পতঞ্জলি পর্যন্ত সংস্থাগুলিকে জমি দেওয়া হচ্ছে। অথচ কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মূলধারার গণমাধ্যম এ বিষয়ে প্রায় নীরব।
মুখ্যমন্ত্রী শর্মার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিপাবলিক টিভির প্রধান সম্পাদক অর্ণব গোস্বামী। তাঁর চ্যানেলে শর্মাকে নিয়মিত “হিন্দু রক্ষক” হিসেবে তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি প্রাক্তন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য সৈয়দা হামিদকে নিশানা করা হয়, কারণ তিনি গুয়াহাটিতে গিয়ে বলেছিলেন—সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকত্ব যাই হোক, প্রত্যেক মানুষের জীবনধারার অধিকার রয়েছে। পরে দিল্লিতে এক গণতদন্ত সভায় অংশ নিতে গেলে তাঁকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরে প্রশ্ন করেন কেন তিনি “অনুপ্রবেশকারীদের” পাশে দাঁড়াচ্ছেন। প্রাইম টাইমে অর্ণব গোস্বামী প্রশ্ন তোলেন—“দেশকে কি ভোটব্যাঙ্কের জন্য বাংলাদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে?” স্ক্রিন জুড়ে চলে—‘Woke Lobby Exposed’, ‘Is there a conspiracy to ignite chaos?’—এরকম শিরোনাম। বিজ্ঞাপনে ঝকঝকে গাড়ি, আর দর্শকদের গিলতে হয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ।
অসমের বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্ট। একদিকে সাংবাদিকদের দমন করে সত্যকে চেপে রাখা হচ্ছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উচ্ছেদ করে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি কর্পোরেটদের হাতে রাজ্যের জমি তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে নীরবে। “আসাম মডেল” আসলে সংবিধানবিরোধী, নির্মম ও বিপজ্জনক এক রাজনীতি, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে গভীর সঙ্কটে ঠেলে দিচ্ছে।