• নালন্দা ধ্বংসকারী খিলজিকে পরাস্ত করেন মহারাজা পৃথু! কুয়াশায় ঢাকা হিন্দু নৃপতির অস্তিত্ব
    প্রতিদিন | ৩১ আগস্ট ২০২৫
  • বিশ্বদীপ দে: ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দ। তুর্কি-আফগান যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজির বাহিনী আছড়ে পড়ল অধুনা বিহারের এই অঞ্চলে। রাতারাতি খাঁ খাঁ শ্মশানে পরিণত হল জ্ঞান ও মেধার এক অনন্ত ভাণ্ডার। আজও ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে সেই আক্রমণের ঘটনা। এহেন ভয়ংকর হামলাকারী খিলজি পরাস্ত হয়েছিলেন এক হিন্দু রাজার হাতে! এমন পরাজয়, যা তাঁকে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। কিছু সময় পরে প্রয়াতও হন তিনি। পরবর্তী সময়ে দিল্লির সুলতান ঘিয়াসউদ্দিনকেও পরাস্ত করেছিলেন সেই রাজা। তিনি পৃথু। অথচ আজও কুয়াশায় ঢাকা তাঁর নাম? কিন্তু কেন?

    সম্প্রতি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ঘোষণা করেছেন ‘আসামের বীরত্বের চিরন্তন গাথা’র অনন্য চরিত্র মহারাজা পৃথুর নামে গুয়াহাটির একটি ফ্লাইওভারের নামকরণ করা হবে। এই ঘোষণার পরই আচমকা ত্রয়োদশ শতাব্দীর মহারাজা পৃথু ফের ভেসে উঠেছেন জনমানসে। কামরূপ রাজ্যের রাজা ছিলেন পৃথু। নিখুঁত পরিকল্পনাতেই তিনি নাকি বখতিয়ার খিলজিকে পরাজিত করেন। ইতিহাসে বখতিয়ার খিলজির নাম বারংবার উচ্চারিত। তাহলে তাঁর সংহারক হয়ে ওঠা পৃথু কেন বিস্মৃত? সেই প্রসঙ্গ পরে। আগে ফিরে দেখা যাক বখতিয়ার খিলজি ও পৃথুর সংঘাত।

    প্রায় ৮০০ বছর ধরে কেবল ভারত নয়, ভিন দেশের মেধাবী ছাত্রদেরও শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞানের এই মহৎ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন বখতিয়ার খিলজি। হানাদারের অক্ষম ক্রোধের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল তা কেবল ভারতের নয়। বলা যায় সমগ্র এশিয়ার শিক্ষাজগতের কাছেই এই ক্ষতি ছিল অভাবনীয় ও অপূরণীয়। আজও ইতিহাসপ্রেমী মানুষের সংবেদনশীল মন চোখের সামনে দেখতে পায় এক মহান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শরীর কীভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে ঘৃণার আগুনে! যতবার নালন্দা ধ্বংসের স্মৃতি ফিরে আসে ততবারই যেন লজ্জায় কুঁকড়ে যায়, যেতে থাকে সভ্যতার হৃদয়। এরপর খিলজির নজর পড়ল তিব্বতের দিকে। সেটা আনুমানিক ১২০৫-০৬ সাল।

    ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত রাজনীতিক-ইতিহাসবিদ কনকলাল বরুয়ার ‘আর্লি হিস্ট্রি অফ কামরূপা’-তে দাবি করা হয়েছে তিস্তার পার দিয়ে গিয়ে কামরূপ ও সিকিমের মধ্যবর্তী পথে তিব্বতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল খিলজির। লক্ষ্য ছিল তিব্বতের বৌদ্ধ মঠে লুটপাট চালানো। কিন্তু তাঁর সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি। কামরূপের পথে যাওয়ার সময়ই তিনি পড়ে যান ‘ফাঁদে’। অথচ খোদ পৃথুই তাঁকে ওই পথে যাওয়ার অনুমতি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। সেই সময় খলজির পক্ষে ঘুণাক্ষরেও বোঝা সম্ভব ছিল না আড়ালে রয়েছে কোন অভিসন্ধি। দ্রুত খবর পৌঁছে যায় আশপাশের গ্রামে। মহারাজা পৃথুর নির্দেশে দ্রুত খালি করে দেওয়া হয় সমস্ত জনপদ। বন্ধ করে দেওয়া খাদ্য জোগানের সমস্ত পথ। এমনকী যে সেতু পেরিয়ে খিলজির বাহিনী কামরূপে প্রবেশ করেছিল সেই সেতুটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। আটকে দেওয়া হয় রাস্তা। উদ্দেশ্য একটাই, ফিরে যাওয়ার উপায়ও বন্ধ করে দেওয়া। অথচ এগনোও যে কঠিন! ক্রমে তাদের সব দিক থেকে ঘিরে ধরে পৃথির বাহিনী। খিলজির প্ৰায় ১২,০০০ ঘোড়সওয়ার ও বিশ হাজার পদাতিকের পুরো সৈন্যবাহিনীর মধ্যে শেষপর্যন্ত বেঁচেছিল মাত্র একশো জন! অথচ খিলজি সেই যুদ্ধের আগেই বুঝে গিয়েছিলেন কী ঘটতে চলেছে। তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ফাঁদে ঘিরে ধরা হয়েছে তাঁদের। কিন্তু ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যায় ‘ফিরিবার পথ নাহি’। এই হারের ধাক্কা সামলাতে পারেননি খিলজি। শোনা যায়, এর অব্যবহিত পরই তাঁর মৃত্যু হয়।

    এই হল ইতিহাস। কিন্তু সত্যিই কি সম্পূর্ণ ইতিহাস এরকমই? খিলজির তিব্বতে আক্রমণের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়া এবং মৃত্যুর ঐতিহাসিক সত্যতা রয়েছে। উত্তর গুয়াহাটিতে অবস্থিত কানাই বঁড়শিবোয়ায় এক শিলালিপি পাওয়া যায়। সেখানে লেখা রয়েছে ‘তুমগা যুগমিতা মধুমাম ত্রয়োদশ কাটামারুপম সমাগত্যা তুরমক্ষ খ্যায়্যামদ্যায়াহ।’ যার অর্থ চৈত্রের তেরো তারিখে তুর্কিরা কামরূপে প্রবেশ করেছিল এবং ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার নেপথ্যে থাকা স্থানীয় নৃপতির পরিচয় কুয়াশাবৃত। কেন? আসলে এর সপক্ষে এখনও কোনও মজবুত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মেলেনি। যদিও অসমের ইতিহাসবিদ রক্তিম পাতরের দাবি, বহু মানুষ নানা পরস্পরবিরোধী কথা বললেও নির্দিষ্ট সূত্র রয়েছে। যা এতকাল উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু তা রয়েছে। এবং সেটাই মহারাজা পৃথুর যুদ্ধজয়ের ‘প্রমাণ’।

    এদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক মঞ্জিল হাজারিকা বলছেন, প্রমাণের অনুপস্থিতিকে অনুপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়। ওই সময়ের আশপাশের ২০০ বছরের ইতিহাসের সব দিক এখনও স্পষ্ট নয়। একথা উল্লেখ করে তাঁর দাবি, অনেক বিষয়ই এখনও গবেষণার যোগ্য। তাই লোকগাথায় জড়িয়ে থাকা নায়কের ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠা হয়তো সময়ের অপেক্ষাই। এই মুহূর্তে অসম সরকারের ঘোষণায় ফের জোরাল হয়েছে তাঁকে নিয়ে চর্চা।
  • Link to this news (প্রতিদিন)