একসঙ্গে দুর্গা গড়েন তিন প্রজন্ম! পুজোর আবহে ব্যতিক্রমী ছবি পুরুলিয়ার মৃৎশিল্প জগতে
প্রতিদিন | ৩১ আগস্ট ২০২৫
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: দাদু-ছেলে-নাতি। দুর্গাপুজোর (Durga Puja in Bengal) সময় মাটি হাতে প্রতিমার রূপ দেন তিন জোড়া হাত। এভাবেই প্রতিবছর একসঙ্গে তিন প্রজন্ম মিলে দুর্গা গড়ে আসছে পুরুলিয়ার রথতলার মৃৎশিল্পী পরিবার। এ এক ব্যতিক্রমী ছবি। কিন্তু ঋণের ফাঁসে বছরের পর বছর আটকে রয়েছে তাঁদের জীবন। মহাজনের বেড়াজাল থেকে দ্রুত মুক্তির জন্যই দেবীর কাছে প্রার্থনা তিন প্রজন্মের মৃৎশিল্পীর।
পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ মৃৎশিল্পীর নাম ফকির পাল, তিনি দাদু। ছেলে রাজীব পাল ও নাতি শুভদীপ। শহর পুরুলিয়ার রথতলাতেই তাঁদের পাকা ছাউনি। সেখানেই এখন দিনরাত কাটছে তাঁদের। ফি বছর পুজোর আগে এমনই হয়। কিন্তু এবার ১০ বছরের রেকর্ড বৃষ্টি ‘অসুর’ হয়ে গিয়েছে। তাই হ্যাপার শেষ নেই। বরাত মিললেও তাতে এবার কাটছাঁট করেছেন শিল্পী। একদিকে পুঁজি কম। অন্যদিকে বৃষ্টি। ফি বছর দাদু-ছেলে-নাতি মিলে ১১টি প্রতিমা গড়েন। কিন্তু এবার সেই বরাত পেলেও তাঁরা ফিরিয়ে দিয়েছেন। কারণ ৯টি প্রতিমার কাজ নিয়ে হিমশিম অবস্থা তাদের। ৬৭ বছরের দাদু ফকির পাল বলেন, “পুঁজি নেই। মহাজনকে এতো টাকা সুদ দিতে হয় কী বলব? বেশি বরাত নেবই বা কীভাবে? তারপর এবার বৃষ্টি। কবে যে আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন মা, কে জানে? ফি বছর মা আসেন, প্রতিমা গড়ি। আমরা সবাই মিলে বলি, একটু ভালো রেখো মা। কিন্তু সেই সুদিন আর আসে না।”
রথতলার ফকির পাল প্রায় ৪০ বছর দুর্গা প্রতিমা গড়ে আসছেন। বাবা অন্নদা পাল মৃৎশিল্পীর কাজ করলেও জেঠুর কাছ থেকে এই শিল্পে হাতেখড়ি তাঁর। অন্যদিকে, কলেজছুট ছেলে রাজীব পাল ১০-১২ বছর বয়স থেকে প্রতিমা তৈরির কাজ করে আসছেন। মা দুর্গার কাজে হাত দিয়েছেন তার কয়েক বছর পর থেকেই। ১৫ বছরের নাতি শুভদীপ পাল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। শহর পুরুলিয়ার মানভূম ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে পড়ে। সে একেবারে নিজের হাতে সম্পূর্ণ দুর্গা গড়তে না পারলেও মায়ের কাঠামোয় মাটি দিয়ে সাহায্য করে। সেইসঙ্গে মায়ের আঙুল, গণেশের ভুঁড়ি, কার্তিকের রূপ ফুটিয়ে তোলে শুভদীপ।
দাদু ফকির পালের কাছ থেকেই এই শিল্পকলা শিখেছে। দুর্গা গড়তে তার এতই উৎসাহ যে দাদু আর কাকাকে সাহায্য করার জন্য এই সময় স্কুলেও যায় না। তবে তাতে ভীষণ রেগে যান দাদু, কাকা, বাবা। কাকা রাজীব পালের কথায়, “এখন আমরা তিন প্রজন্ম ধরে প্রতিমা গড়ে আসছি। সারাদিন মায়ের রূপ ফুটিয়ে তুলতে পড়ে আছি। তবে বিশ্বাস হারায়নি। দিন বদল হয়তো একদিন হবেই।” শুভদীপের কথায়, “আমি কয়েক বছর ধরেই দুর্গা প্রতিমা গড়ার সময় দাদু ও কাকাকে সাহায্য করে থাকি। খুব ভালো লাগে আমার। মাটি দিতে দিতে তারপরে রঙের প্রলেপ পড়তেই মায়ের রূপ ফুটে ওঠে। তখন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।”
প্রায় ফি বছরই এই পরিবার মাটি, কাঠ, খড়ের জন্য ২৫ হাজার, সাজসজ্জার জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার, শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে ৪০ হাজার বিনিয়োগ করে থাকে। তবে গিয়ে কিছুটা লাভের মুখ দেখেন তাঁরা। তারপর কালীপুজোর সময় তাঁদের পরিবারের নতুন জামাকাপড় হয়। পুজোয় আর কোনওভাবেই পরিবারের সকলকে নতুন জামাকাপড় কিনে দিতে পারেন না শিল্পী ফকির পাল। তাই আক্ষেপ ঝরে পড়ে।