• প্রেসক্রিপশনে নেই রোগেরই উল্লেখ! অডিটে কাঠগড়ায় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা
    বর্তমান | ৩১ আগস্ট ২০২৫
  • বিশ্বজিৎ দাস, কলকাতা: সই দেখে কখনও মনে হবে ভূমধ্যসাগরের ঢেউ, কখনও বঙ্গোপসাগরের স্রোত! সেখানে চিকিৎসকের নাম খুঁজতে যাওয়া বৃথা। পেনের চিত্রবিচিত্র আঁচড় ছাড়া কিছুই উদ্ধার করতে পারবেন না। হাসতে হাসতে কথাগুলি বলছিলেন রাজ্যজুড়ে সরকারি হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রেসক্রিপশন অডিটের দায়িত্বে থাকা আধিকারিকদের একজন। জানালেন, ৯০ শতাংশ প্রেসক্রিপশনেই নেই চিকিৎসকের পুরো নাম। এমনকী ডাক্তারের যা প্রধান কাজ, রোগ ধরতে পারা বা সেসম্পর্কে অনুমান-আশঙ্কা—সেই ডায়াগনসিসের কোনও উল্লেখ নেই কমবেশি ৭০ শতাংশ প্রেসক্রিপশনে!

    সম্প্রতি রাজ্যে শুরু হয়েছে প্রেসক্রিপশন অডিট। একেবারে মেডিক্যাল কলেজ থেকে ব্লক প্রাইমারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র-গ্রামীণ হাসপাতাল পর্যন্ত। প্রায় ৫০০ সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রেসক্রিপশন অডিট চলছে। প্রতিটি বিভাগ থেকে গড়ে ৩০টি করে প্রেসক্রিপশন সংগ্রহ করে দেখা হচ্ছে, কতটা নিয়ম মেনে লেখা হয়েছে সেগুলি। এভাবে ফি মাসে প্রায় ৫০ হাজার করে প্রেসক্রিপশন অডিট করে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। তাঁরা জানালেন, অসংখ্য এমন প্রেসক্রিপশন পাচ্ছি, যেখানে চিকিৎসকের কোনও সই-ই নেই। ওষুধের নাম লিখে পাশে ১০, ৫, ১৫ এমন সব লেখা রয়েছে। তাছাড়া ডাক্তার দেখালে প্রেসক্রিপশনে ‘প্রভিশনাল ডায়াগনসিস’-এর উল্লেখ থাকবে। মানে রোগীকে দেখে চিকিৎসক কী রোগ হয়েছে বলে অনুমান করছেন। তারপর আসবে সেই রোগ আদৌ হয়েছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বিভিন্ন রোগ ও রক্ত পরীক্ষার প্রশ্ন। প্রায় ৭০ শতাংশ প্রেসক্রিপশনে সেসবের কোনও নামগন্ধ মেলেনি। শুধুমাত্র রোগীর নাড়ির গতি, রক্তচাপ, ওজন এসবের উল্লেখ করেই নির্দিষ্ট ডোজে কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছেন ডাক্তাররা। কিন্তু, রোগীর কী হয়ে থাকতে পারে, কেন ওষুধ দেওয়া হল, তার বিন্দুবিসর্গ নেই। ফলে রীতিমতো সমস্যায় পড়ছেন রোগীরা। পরের ‘ফলো আপে’ যদি সেই চিকিৎসক না থাকেন, নতুন ডাক্তার ‘প্রভিশনাল ডায়াগনসিস’ না দেখে নতুন করে রোগীকে দেখা শুরু করছেন। ফের দেওয়া হচ্ছে নতুন ওষুধ, টেস্ট।  

    এছাড়া ওষুধের উচ্চারণ বা বানান সম্পর্কে যাতে ধোঁয়াশা না থাকে, সেজন্য সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের ক্যাপিটাল লেটার বা বড় হাতের অক্ষরে ওষুধের নাম লিখতে বলা হয়েছিল। তা মানা হচ্ছে মাত্র ৫-১০ শতাংশ ক্ষেত্রে। আর ই-প্রেসক্রিপশন? মাত্র ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তা মিলছে। অন্যত্র সব প্রেসক্রিপশনই লেখা হচ্ছে হাতে।

    স্বাস্থ্যদপ্তর সূত্রের খবর, সবচেয়ে উদ্বেগের প্রবণতা হল যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক লেখা। এক পদস্থ স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, বাড়িতে থাকা রোগীকে আউটডোরে দেখে ‘মেরোপেনামে’র মতো তৃতীয় প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। মশা মারতে কামান দাগার মতো কড়া অ্যান্টিবায়োটিকের উল্লেখ রয়েছে গুচ্ছ প্রেসক্রিপশনে। এধরনের প্রতি ১০০টির মধ্যে ৬০টি প্রেসক্রিপশনেই তিনটি করে অ্যান্টিবায়োটিকের উল্লেখ রয়েছে। এমনকী পাঁচ বা তার বেশি অ্যান্টিবায়োটিকও রয়েছে কোথাও কোথাও। তবে ইতিবাচক চিত্রও ধরা পড়েছে এই অডিটে। ২০২৩-’২৪ সালের তুলনায় ওষুধের ‘ব্র্যান্ড নেম’ লেখা অনেক কমেছে। এক পদস্থ স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ঠিকমতো প্রেসক্রিপশন লেখা হলে রোগীর মঙ্গল, সরকারেরও মঙ্গল।
  • Link to this news (বর্তমান)