• গত ১৪ বছরে পরিযায়ীর সংখ্যা কমেছে রাজ্যে! দাবি মমতার সরকারেরই, তবে ৪৫ শতাংশ বেড়েছিল বাম-জমানার শেষে
    আনন্দবাজার | ৩১ আগস্ট ২০২৫
  • বাম জমানার শেষ পর্বের তুলনায় রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে। অন্তত তেমনটাই দাবি করা হয়েছে রাজ্য সরকারের দেওয়া হিসাবে।

    ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যার বিচারে দেশের মধ্যে শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ। সে রাজ্যের অন্তত ১.২৩ কোটি শ্রমিক ভিন্‌রাজ্যে কর্মরত ছিলেন সেই সময়ে। ২০১১ সালে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন অখিলেশ যাদব। বর্তমানে যোগী আদিত্যনাথের আমলে সেই সংখ্যাটা কত, তার কোনও সরকারি হিসাব প্রকাশ্যে নেই। ২০১১ সালের জনগণনার তথ্য অনুযায়ী, তালিকায় উত্তরপ্রদেশের পরেই বিহার এবং রাজস্থান। পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল সাত নম্বরে। সেই সময়ে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৪.০৫ লাখ। তাঁদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি (১৪.৫২ লাখ)। পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৯.৫৩ লাখ।

    কিন্তু বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিন্‌রাজ্যে হেনস্থার অভিযোগ ঘিরে বিতর্কের আবহে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সরকার দাবি করছে, গত ১৪ বছরে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে! রাজ্যের ‘কর্মসাথী’ প্রকল্প অনুযায়ী, নথিভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২২ লক্ষ ৪০ হাজার। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা এই হিসাব দিয়েছেন। অর্থাৎ, রাজ্য সরকারের দাবি অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে ১ লাখ ৬৫ হাজার।

    যদিও বিভিন্ন মহলের মতে, নাম লেখানো নেই, এমন অংশ ধরলে বাইরে কর্মরতদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। রাজ্যের শ্রম দফতর সূত্রেও খবর, যে সংখ্যাটা বলা হচ্ছে, সেটি নথিভুক্ত। এমন পরিযায়ী শ্রমিকও রয়েছেন, যাঁদের নাম নথিভুক্ত নয়। তবে শ্রম দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘অতিমারি কালের পর রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে সরকারের খাতায় নাম নথিভুক্ত করার একটা প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। ফলে ফারাক খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। বড়জোর ২-৪ লাখ হবে।’’

    আবার ২০১১ সালের জনগণনায় উঠে আসা তথ্য বলছে, বাম জমানার শেষের দিকে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছিল। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, রাজ্যে যত জন পরিযায়ী শ্রমিক ছিল, সেই সংখ্যাটা ৪৫ শতাংশ (৭.১৮ লক্ষেরও বেশি) বেড়েছে ২০১১ সালে। এ প্রসঙ্গে বাম জমানার শেষ পর্বে রাজ্যের শ্রম দফতরের মন্ত্রিপদে থাকা অনাদি সাহু বলেন, ‘‘রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক আগেও ছিলেন। এখনও আছেন। ভবিষ্যতেও থাকবেন। কিন্তু এখন একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সেটা হল, কৃষকেরাও চাষবাসের কাজকর্ম ছেড়ে এখন ভিন্‌রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করছেন। এটা আগে ছিল না।’’

    বর্তমানে রাজ্য সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যার যে হিসাব দিচ্ছে, তার সঙ্গে অনেকেই সহমত নন। তাঁদের যুক্তি, কয়েক বছর আগে কোভিড-কালে অন্যান্য রাজ্য থেকে ৪০ লক্ষের বেশি পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় ফেরত এসেছেন বলে সেই সময় জানানো হয়েছিল রাজ্য সরকারের তরফে। সেই তথ্য হাতিয়ার করে এখন অনেকের প্রশ্ন, পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা বাস্তবে ঠিক কত, তার কোনও সমীক্ষা কি হয়েছে?

    ভিন্‌রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর হেনস্থার অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সরকার। অভিযোগ, মূলত বিজেপিশাসিত রাজ্যেই বাংলার শ্রমিকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। নথি-পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের অকারণে পাকড়াও করা হচ্ছে। আটকে রাখা হচ্ছে দিনের পর দিন। বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে অনেককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে ভিন্‌রাজ্যে ‘আক্রান্তের শিকার’ বহু পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় ফিরে এসেছেন রাজ্য সরকারের উদ্যোগে।

    পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরে আসার জন্য উৎসাহ দিতে ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এই প্রকল্প অনুযায়ী, রাজ্যে ফিরে এলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা মাসে পাঁচ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। বেশ কিছু দিন ধরেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছিল ‘কর্মসাথী’ প্রকল্পে। তার জন্য চালু আছে একটি পোর্টাল। মুখ্যমন্ত্রীর নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, এ বার ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘শ্রমশ্রী’ পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করাতে হবে। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, এই দুই পোর্টালের সেতুবন্ধন করে তথ্য মেলানো হবে। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, সে ক্ষেত্রে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যাটা বাস্তবে কত, তার একটা আন্দাজ পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

    ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্প ঘোষণার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা ফিরবেন, তাঁরা ভ্রমণ সহায়তা-সহ এককালীন পাঁচ হাজার টাকা করে পাবেন। পুনর্বাসন ভাতা এটা। এর মানে এক বছর, নতুন কাজের ব্যবস্থা না-হওয়া পর্যন্ত আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। বাংলায় যে ২২ লক্ষ ৪০ হাজার শ্রমিক বাইরে আছেন, তাঁরা সকলে ‘শ্রমশ্রী’র সুবিধা পাবেন। যাঁরা করেননি, তাঁরা নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন।’’

    মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, রাজ্যের ‘উৎকর্ষ বাংলা’ প্রকল্পের আওতায় শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকেরাও তার সুবিধা পাবেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘ফিরে আসা শ্রমিকদের কার কী দক্ষতা আছে, সেটা দেখা হবে। দক্ষতা থাকলে দরকারে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। এ ছাড়া আমরা ‘জব কার্ড’ দেব। কর্মশ্রী প্রকল্পে ৭৮ লক্ষ জব কার্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া লোনের ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যসাথী কার্ড দেব। স্বাস্থ্যসাথী থাকবে। বাড়ি না-থাকলে কমিউনিটি সেন্টারে থাকার ব্যবস্থা হবে। স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে তাঁদের ছেলেমেয়েদের। কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রীর সুবিধাও পাবেন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন, ‘‘কিছু দিনের মধ্যে যাঁরা রাজ্যে ফিরে এসেছেন, তাঁদের স‌ংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তাঁরা পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করাতে পারবেন। শ্রমশ্রী পোর্টালে নাম তুললে তাঁদের একটা আই কার্ড দিয়ে দেওয়া হবে। এর ফলে রাজ্য সরকারের সুযোগ-সুবিধাগুলি পাবেন তাঁরা।’’

    কিন্তু রাজ্য সরকারের এই সব সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কত জন পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় ফিরবেন, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। প্রশাসনিক মহলেরই অন্য একটি অংশের বক্তব্য, ‘‘অন্য রাজ্যে বেশি মজুরি মেলে বলেই বহু মানুষ এ রাজ্য থেকে বাইরে কাজ করতে যান। বিশেষত, দক্ষিণ ভারতে। ভাতার আশ্বাসে তাঁদের মধ্যে কত অংশ ফিরে আসবেন, আগাম আন্দাজ করা কঠিন। আবার ‘কর্মসাথী’র সঙ্গে ‘শ্রমশ্রী’কে মিলিয়েও চলতে হবে।’’

    অন্য দিকে, ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করে কেউ যদি বাড়তি রোজগারের আশায় ভিন্‌রাজ্যে চলে যান, সে ক্ষেত্রে সরকারি অর্থ অপচয়েরও আশঙ্কা থাকছে। সব দিক বিবেচনা করেই এগোনো হচ্ছে বলে সরকারি ওই সূত্রের দাবি।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)