কখনও গ্রাহকের অজানতেই অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাচ্ছে দু’-পাঁচ হাজার বা তারও বেশি টাকা! কখনও আবার চোখে পড়লেও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, ‘যিনি পাঠিয়েছেন, তিনিই বুঝবেন, আমার দায় নেই’ ভেবে। কখনও আবার মশকরা চলছে, ‘ভালই হয়েছে টাকা এসেছে। পুজোয় ভাল খরচ করা যাবে।’ কখনও এক বন্ধু অপরকে টিপ্পনী করছেন, ‘তোর না লাগলে আমায় দিস। এই বাজারে এক টাকাও ফেলনা নয়।’ কিন্তুব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এ ভাবে হঠাৎ আসা টাকাই ধনে-প্রাণে শেষ করে দিতে পারে কাউকে! এমনই অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগী থেকেআইনজীবী, সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞেরা। ফলে, গোড়াতেই সতর্ক হতে বলছেন তাঁরা। কারণ, অ্যাকাউন্টে ঢোকা এমন টাকা খরচ করলেই অ্যাকাউন্টের মালিক সরাসরি পড়তে পারেন ইডি, সিবিআই বা পুলিশের নজরে।
এমনই ঘটনা ঘটেছিল মধ্যমগ্রামের এক যুবকের সঙ্গে। নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এমন পাঁচ হাজার টাকা যে ঢুকেছে, তিনি বুঝতেই পারেননি। এক সময়ে ব্লক হয়ে যায় তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটি। ব্যাঙ্কে গিয়ে জানতে পারেন, কেন্দ্রীয়সাইবার পুলিশ তাঁর নামে চিঠি পাঠিয়েছে। সেই কারণেই তাঁর অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছে। ফলে, প্রবল আতান্তরে পড়েন ওই যুবক। এক দিকে ছেলের অসুস্থতা, অন্য দিকে মাসের খরচ। অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকলে তিনি কী করে সামলাবেন, এই ভেবে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াতে থাকেন। ওই পাঁচ হাজার টাকাটুকু ছাড়া অ্যাকাউন্টে থাকা বাকি টাকা যে তিনি ব্যবহার করতে পারেন, সেই তথ্যই তিনি জানতে পারেননি। দিনকয়েকের মধ্যেই হৃদ্রোগে মৃত্যু হয় তাঁর।
আইনজীবী তথা সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এমন ঘটনা নিয়ে অভিযোগ প্রায়ই তাঁদের কাছে আসছে। তাঁর কথায়, ‘‘রোজই এমন অভিযোগ পাচ্ছি। সাধারণ মানুষ খুব সমস্যায় পড়ছেন। প্রতারণার কয়েক হাজার টাকা, কখনও কয়েক লক্ষ টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর পরে ফোন করে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টের মালিকদের বলা হচ্ছে, ভুল করে টাকাটা চলে গিয়েছে। অন্য একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘আমার এই অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিন দয়া করে।’ ভাল মানুষের মতো এই পথে পা বাড়ালেই বিপদ। তদন্তকারী সংস্থা দেখছে, প্রতারণার টাকা তোলা হয়েছে বা অন্যত্র পাঠানো হয়েছে। ফলে, যিনি কোনও ভাবেই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁর কাছে পৌঁছচ্ছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু এমন টাকা ঢুকলেও সেই টাকাটুকু ছাড়া নিজস্ব টাকা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।’’
এমনই আর এক ভুক্তভোগী, কলকাতার একটি বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী। দিন দশেক আগে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে বেনামি দু’হাজার টাকা ঢোকে। তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কেফোন করে টাকাটা কোথা থেকে এসেছে জানতে চান। কিন্তু ব্যাঙ্ক সদুত্তর দিতে পারেনি। সচেতন নাগরিক হিসাবে তিনি নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটি ‘ব্লক’ করেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি এখন সমস্যায় পড়েছেন,ব্যাঙ্ক এ নিয়ে আর কিছুই নাজানানোয়। অ্যাকাউন্টটি যে হেতু বেতন পাওয়ার জন্য তৈরি করা, তাই কী ভাবে বেতন আসবে এবং মাসের খরচ তিনি কী ভাবে চালাবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। ঝক্কি বেড়েছেসরাসরি ব্যাঙ্কের শাখায় গিয়েও টাকাটি কোথা থেকে এসেছে জানতে না পারায়। নিরুপায় হয়ে তিনি অ্যাকাউন্টটি খুলে দেওয়ার অনুরোধ করে এসেছেন ব্যাঙ্কে। সেখানকার ম্যানেজার বলেন, ‘‘অনলাইন পদ্ধতিতে আমাদের ভরসাই নেই। এত রকম ভাবে প্রতারণা চলছে যে, সামলে ওঠা যাচ্ছে না।’’
কিন্তু এমন ঘটলে সাধারণ মানুষ কী করবেন? বিভাস বললেন, ‘‘সতর্ক হতে হবে নিজেকেই। সর্বক্ষণ নজর রাখতে হবে, কোথা থেকে কী টাকা ঢুকছে, তার উপরে। বেনামি এইরকম টাকা ঢুকলেই ব্যাঙ্ককে জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের দু’টি হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে বেনামি টাকাটুকু ছাড়া বাকি টাকারউপরে কোনও তদন্তকারী সংস্থা কোনও রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে না। সেটাই লিখিত ভাবে জানিয়ে ব্যাঙ্ককে ব্যবস্থা নিতে বলতে হবে।’’
‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব অ্যান্টি হ্যাকিং’-এর অধিকর্তা সন্দীপ সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘পুলিশে অভিযোগ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কে চিঠি দিয়ে বলতে হবে, এই বেনামি টাকার দায় আমি নিতে পারব না, যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফেরত পাঠান। ওই টাকাটুকু ছাড়া নিজের বাকি টাকা ব্যবহার করতে কোনও বাধা নেই। তবে ব্যাঙ্ক বা পুলিশকে বলেও কাজ না হলে এর পরে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পথ খোলা আছে।’’