প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার আওতায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দে কত বাড়ি তৈরি বাকি রয়েছে সে সম্পর্কে কয়েক সপ্তাহ আগেই সবিস্তার তথ্য জেলা প্রশাসনগুলির থেকে চেয়েছে রাজ্য সরকার। প্রশাসনিক সূত্রের অনুমান, এর নেপথ্যে কেন্দ্রকে তথ্য দেওয়ার প্রয়োজন থাকতে পারে। কিন্তু গত প্রায় তিন বছর ধরে অনেক ধরনের তথ্যের আদানপ্রদান হয়েছে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে। তার পরেও চালু হয়নি বরাদ্দ। ফলে বাড়ি তৈরি নিয়ে নবান্নের নতুন ঘোষণায় যে বিপুল বরাদ্দের বোঝা রাজ্যের ঘাড়ে চাপতে চলেছে, তা মোকাবিলার উদ্দেশ্যেই কি ফের এই তৎপরতা—চর্চা চলছে তা নিয়ে।
লিখিত ভাবে পঞ্চায়েত দফতর জেলা প্রশাসনগুলিকে জানিয়েছে, তাদের দেওয়া ২০২৪ সালের রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার (গ্রামীণ) আওতায় ৪০,৯৬৮টি বাড়ি তৈরি বাকি রয়েছে বলা ছিল। কেন্দ্রের পোর্টাল অনুযায়ী সেই সংখ্যা ৪৭,৯৮১টি। ফলে ব্যবধান থাকা ৬৯২৩টি বাড়ি এবং উপভোক্তারও সবিস্তার তথ্য প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে তা জানাতে হবে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রককে। সূত্রের বক্তব্য, অসমাপ্ত বাড়িগুলির মধ্যে কিছু উপভোক্তা টাকা পেয়েও বাড়ি তৈরি শুরু বা সম্পূর্ণ করেননি, কিছু উপভোক্তার মৃত্যু হয়েছে, কারও নিজস্ব জমি নেই, আবার কিছু উপভোক্তা ঠিকানা বদল করেছেন। বরাদ্দের হিসাব ধরলে এই প্রকল্পে কেন্দ্রের ভাগ ৬০% এবং রাজ্যের তা ৪০%। সেই হিসেবে বিপুল অর্থ অব্যবহৃত। তারই সবিস্তার তথ্য চাওয়া হয়েছে।
জেলা-আধিকারিকদের একাংশের বক্তব্য, ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রায় ১১ লক্ষ উপভোক্তার তালিকাকে অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগে তার পর থেকেই বরাদ্দ বন্ধ হয়। আসতে থাকে একের পর এক কেন্দ্রীয় দল। কেন্দ্র এবং দলগুলির সুপারিশে বহু পদক্ষেপ করতে হয় রাজ্যকে। এমনকি, ভবিষ্যতে এমন গরমিল ধরা পড়বে না, রাজ্যকে দিতে হয় সেই আশ্বাসও। তবে চলতি মাসের গোড়াতেই সংসদে একটি প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক জানিয়েছিল, রাজ্যের দেওয়া ‘অ্যাকশন টেকন রিপোর্ট’ সন্তোষজনক নয়। তাই অর্থ মঞ্জুর করা হয়নি। সম্ভবত সে কারণেই সবিস্তার তথ্য চাওয়া হচ্ছে জেলাগুলি থেকে। অবশ্য পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার শুক্রবার বলেন, “এমন রিপোর্ট চাওয়াই হয়। এটা আমাদের নিয়মমাফিক কাজ। প্রকল্পের বরাদ্দ কবে চালু হবে, তা স্পষ্ট নয়। এটা কেন্দ্রের রাজনৈতিক প্রতিহিংসারই প্রতিফলন।”
তবে প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের বক্তব্য, ২০২৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে ১২ লক্ষ উপভোক্তাকে বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়ার ঘোষণা করেছিল রাজ্য। তাতে খরচ হচ্ছে কমবেশি ১৪,৪০০ কোটি টাকা। অবশ্য চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-২৬) বাজেটে শুধু বাড়ি তৈরির খাতে ১৫,৪৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে রাজ্য। ফলে এই অর্থের জোগান রয়েছে। কিন্তু সমান্তরালে আরও ১৬ লক্ষ উপভোক্তাকে সেই বরাদ্দ দেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ঘটনাচক্রে, আগামী বছরই এ রাজ্যে বিধানসভা ভোট। এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হলে খরচ হবে অন্তত ১৯,২০০ কোটি টাকা। চলতি আর্থিক পরিস্থিতিতে যার সংস্থান করা কঠিন। তাই সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, কেন্দ্রের কাছে যথাযথ তথ্য দিলে যদি বরাদ্দের সুদিন ফেরে, তাতে রাজ্যের ভারও লাঘব হতে পারে অনেকটা।
আধিকারিকদের একাংশের বক্তব্য, এই প্রকল্পের ‘ওপেনিং ব্যালান্স ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট’ অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে রাজ্যের হাতে ছিল প্রায় ১৬৯৩ কোটি টাকা। সে বছর শুধু রাজ্যের বরাদ্দ ছিল প্রায় ১৭৯২ কোটি টাকা। এতে সব মিলিয়ে প্রায় ১১০৮ কোটি টাকা খরচের পরে রাজ্যের ‘নোডাল অ্যাকাউন্ট’-এ ছিল প্রায় ২৪২৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গের ‘নোডাল অ্যাকাউন্টে’ ছিল ২২৪৮ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাতায় ২১৮৪ কোটির কিছু বেশি অর্থ ছিল। সমান্তরালে, অর্থ মন্ত্রকের দাবি, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত এই খাতে ২৫,৭৮৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল রাজ্যকে। তাতে প্রায় ৪৫.৬৯ লক্ষ বাড়ি তৈরি করতে হত। কিন্তু ২০১৮ সালে আবাস প্লাস (প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ) সমীক্ষা থেকে ২০২২ সালে বাড়ির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করার পরে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সেই দিক থেকে এখন হিসাব মেলানোই সম্ভবত অন্যতম লক্ষ্য হয়ে উঠেছে বলে বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান।