আজকাল ওয়েবডেস্ক: সম্প্রতি রাভি নদীর ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাকিস্তানের কার্তারপুর সাহিব গুরুদ্বারা, যেখানে শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক চিরনিবাস লাভ করেছিলেন। তবে এই স্থানের স্মৃতিচারণ অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি মনে না করা হয় ভারতের পাঞ্জাবের গুরদাসপুর জেলার আরেকটি ঐতিহাসিক শহর কালানৌরকে। মাত্র ২০ কিলোমিটারের ব্যবধানেই দুটি স্থান, অথচ ভারতীয় ঐতিহ্যে তাদের তাৎপর্য যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই দিকের প্রতীক।
কার্তারপুরকে ঘিরে আছে সমতার বাণী, সেবার সংস্কৃতি ও প্রার্থনার ধারাবাহিকতা। অন্যদিকে, কালানৌর বহন করছে সাম্রাজ্যিক মহিমার সূচনার স্মৃতি—এখানেই ১৫৬৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র ১৩ বছরের জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবরকে সম্রাট হিসেবে অভিষেক করা হয়েছিল। এই অভিষেক মঞ্চ তখত-ই-আকবরী আজ ইতিহাসের পাতায় অম্লান হলেও বাস্তবে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে।
গুরু নানক ১৫৩৯ সালে পরলোকগমন করেছিলেন, অর্থাৎ আকবরের অভিষেকের প্রায় ১৭ বছর আগে। তবুও দুটি উত্তরাধিকার যেন সমান্তরালভাবে চলেছে—নানকের আধ্যাত্মিক বাণী সমাজে সমতা ও ভ্রাতৃত্বের চেতনা ছড়িয়েছে, আর আকবর সাম্রাজ্যের শক্তি সংহত করে ভারতীয় ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন।
আকবর কেবল মুঘল শক্তির প্রতীক ছিলেন না; তিনি নতুন উদীয়মান শিখ ধর্মের প্রতিও দেখিয়েছিলেন বিরল সহনশীলতা। তৃতীয় গুরু অমর দাসের আমন্ত্রণে গোবিন্দওয়ালে লঙ্গরে বসে সমতার বার্তা মেনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভোজন করেছিলেন সম্রাট। শাসকের অহঙ্কার পাশে রেখে আধ্যাত্মিক সমতার কাছে মাথা নোয়ানোর এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
আকবর আশপাশের গ্রামগুলিকে রাজস্ব ছাড় দেন, এমনকি গুরু রামদাসকে ভূমি প্রদান করেন, যেখানে পরে খনন শুরু হয়েছিল অমৃত সরোবরের—যার চারপাশে গড়ে ওঠে রামদাসপুর, আজকের অমৃতসর। এই ঘটনার মাধ্যমে মুঘল শাসক ও শিখ ধর্মের মধ্যে এক সৌহার্দ্যময় সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল, যদিও পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের নীতিতে তা বদলে যায়।
কার্তারপুর আজও জীবন্ত বিশ্বাসের কেন্দ্র। ২০১৯ সালে করিডর খোলার পর ভারতীয় তীর্থযাত্রীরা সেখানে গিয়েছেন, যদিও বর্তমানে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর কারণে তা বন্ধ। বারবার রাভির বন্যায় ধ্বংস হলেও ভক্তরা প্রতিবারই গুরুদ্বারাকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এটি কেবল ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং শিখ আত্মপরিচয় ও সম্প্রদায়সেবার প্রতীক।
অন্যদিকে, কালানৌরের তখত-ই-আকবরী প্রায় বিস্মৃত। শহরের মানুষজনও এর অবস্থান সম্পর্কে উদাসীন। সর্ষে ক্ষেত, বাড়িঘর, দোকান আর আবর্জনার স্তূপের মাঝেই পড়ে আছে ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি। প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের একটি ছোট ফলক ছাড়া সেখানে এর গুরুত্ব বোঝানোর কোনও চিহ্ন নেই। অথচ এখান থেকেই আকবর শুরু করেছিলেন এক দীর্ঘ শাসনকাল, যার প্রভাব ভারতীয় প্রশাসনিক কাঠামো ও রাজনীতিতে আজও পরোক্ষভাবে টিকে আছে।
তখত-ই-আকবরী মূলত লাল ইটের একটি প্রায় ১১ বর্গমিটারের মঞ্চ। কেন্দ্রে একটি বর্গাকার জলাধার, চারপাশে ক্ষুদ্র ট্যাঙ্ক, যেখানে জল ভরে প্রতিফলনের মাধ্যমে অভিষেককে জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলা হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, এই সরল কিন্তু সুবিন্যস্ত স্থাপত্য আকবরের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও কর্তৃত্বের প্রতীক। কিন্তু আজ তা গ্রামীণ জীবনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে।
দুটি স্থান তুলনা করলে ভারতীয় ঐতিহ্যের বৈপরীত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কার্তারপুর আজও শিখ সম্প্রদায়ের জন্য প্রাণবন্ত ভক্তির কেন্দ্র, যেখানে সমতা, সেবা আর ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা প্রবাহিত। আর কালানৌর, যেখান থেকে মুঘল শক্তির নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল, তা আজ নিঃশব্দে ভগ্নাবশেষে পরিণত—ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কেবল বইয়ের পাতায় টিকে আছে।
কার্তারপুর আজও ভক্তির নবজাগরণের প্রতীক, আর কালানৌর কেবল বিস্মৃত মহিমার চিহ্ন। এই বৈপরীত্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভারতের অতীত কেবল একমুখী নয়—এখানে সমান্তরালে গড়ে উঠেছে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, সাম্রাজ্যিক ক্ষমতা, এবং সময়ের সাথে সাথে তাদের স্মৃতির ভিন্ন ভিন্ন পরিণতি।