গত ১৪ বছরে বাংলায় পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে, দাবি রাজ্য সরকারের
দৈনিক স্টেটসম্যান | ৩১ আগস্ট ২০২৫
গত ১৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে বলে দাবি করেছে রাজ্য সরকার। তৃণমূল সরকার সূত্রে খবর, বর্তমানে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২২ লক্ষ ৪০ হাজার, যা ২০১১ সালের তুলনায় কম। ওই বছরের জনগণনা অনুসারে, রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৪ লক্ষ ৫ হাজার। এই হিসেবে, রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার। রাজ্য সরকার মনে করছে, কর্মসংস্থানমুখী বিভিন্ন প্রকল্প এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার কারণে এখন অনেক মানুষ রাজ্যের মধ্যেই কাজ খুঁজে পাচ্ছেন। ফলে ভিনরাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
তবে এই দাবির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। কারণ, রাজ্য সরকারেরই দেওয়া এক তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় অন্যান্য রাজ্য থেকে ৪০ লক্ষেরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় ফিরেছিলেন। সেই সংখ্যার সঙ্গে বর্তমান পরিসংখ্যানের বিস্তর ফারাক থাকায় অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে এখন প্রকৃত সংখ্যা কত? এই পরিসংখ্যান কি বাস্তবের সঙ্গে খাপ খায়? শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসাবে অনেকটাই কম দেখানো হয়েছে, কারণ এই হিসেব কেবলমাত্র নথিভুক্ত শ্রমিকদেরই অন্তর্ভুক্ত করছে। অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের কোনও সরকারি প্রকল্পে নাম নেই, ফলে তাঁরা এই পরিসংখ্যানে ধরা পড়েননি।
সরকারি আধিকারিকদের দাবি, কোভিড পরবর্তী সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে সরকারি প্রকল্পে নাম লেখানোর প্রবণতা বেড়েছে, ফলে সংখ্যার তারতম্য খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। তবে বাস্তবে এমন বহু শ্রমিক আছেন যাঁরা তথ্য-প্রযুক্তির অভাবে বা সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এখনও নাম নথিভুক্ত করেননি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা ২৫-৩০ লক্ষের বেশি হতে পারে।
একই সঙ্গে উঠে আসছে অতীতের একটি পরিসংখ্যানও। ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৪৫ শতাংশ বেড়েছিল। তখন রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট সরকার। বাম সরকারের আমলে শ্রমমন্ত্রী অনাদি সাহু জানান, আগে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও কৃষিজীবীরা চাষের কাজ ছেড়ে বাইরে শ্রমিকের কাজে যেতেন না। কিন্তু এখন অনেক কৃষক জমি ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে বাইরে চলে যাচ্ছেন, যা একটি নতুন সামাজিক প্রবণতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি ভিনরাজ্যে বাংলা ভাষাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থার অভিযোগ ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও বাংলার শ্রমিকদের আটক করা, বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে হেনস্থা করা, এমনকি বাংলায় ফেরত পাঠানোর মতো অভিযোগ উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এই ঘটনাগুলি নিয়ে সরব হয়েছেন এবং রাজ্যে ফিরে আসা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার চালু করেছে ‘শ্রমশ্রী’ নামে একটি নতুন প্রকল্প।
‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্পের অধীনে, যে সব পরিযায়ী শ্রমিক ভিনরাজ্য থেকে ফিরে আসবেন, তাঁদের এককালীন ৫ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হবে। এটি একটি পুনর্বাসন সহায়তা, যা প্রাথমিক ভাবে এক বছরের জন্য দেওয়া হবে বা যতদিন না নতুন কাজের ব্যবস্থা হয়। এই প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করতে হবে শ্রমশ্রী পোর্টালে। যাঁরা ইতিমধ্যেই ‘কর্মসাথী’ প্রকল্পে নাম লিখিয়েছেন, তাঁদের তথ্য মিলিয়ে দেখা হবে। ফিরে আসা শ্রমিকদের দেওয়া হবে একটি আই-কার্ড, যাতে তাঁরা সরকারি সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজ্যে ফিরে আসা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ‘উৎকর্ষ বাংলা’ প্রকল্পের অধীনে। যাঁদের কোনও পেশাগত দক্ষতা নেই, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। যাঁদের বাড়ি নেই, তাঁদের জন্য কমিউনিটি সেন্টারে থাকার ব্যবস্থা হবে। খাদ্যসাথী ও স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দেওয়া হবে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্কুলে ভর্তির সুযোগ তৈরি করা হবে। কন্যাশ্রী ও শিক্ষাশ্রী-র সুবিধাও পাওয়া যাবে। এছাড়া, কর্মশ্রী প্রকল্পে নাম তুলে জব কার্ডও দেওয়া হবে এবং ঋণের ব্যবস্থা থাকবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন।
তবে প্রশাসনের অন্দরেই একটি অংশের বক্তব্য, ভিনরাজ্যে যে সব শ্রমিক কাজ করতে গিয়েছেন, তাঁরা অনেক বেশি মজুরি পান। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারত বা দিল্লি, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে। সেখানে কাজ ছেড়ে ফিরে এসে রাজ্যে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের কোনও কাজে যুক্ত হওয়া অনেকের পক্ষে বাস্তবসম্মত নয়। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সরকারি ভাতা ও সুবিধার আশায় আদৌ কত জন শ্রমিক স্থায়ীভাবে ফিরে আসবেন?
আরেকটি আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে, কেউ যদি শ্রমশ্রী প্রকল্পে নাম লিখিয়ে ভাতা পাওয়ার পর আবার ভিনরাজ্যে চলে যান, তাহলে তা সরকারি অর্থের অপচয় হিসেবে দেখা যেতে পারে। ফলে প্রকল্পটি কার্যকর করতে হলে প্রকৃত পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা নির্ধারণ, তাঁদের পর্যবেক্ষণ এবং নথিভুক্তিকরণ অত্যন্ত জরুরি। এজন্য সরকার ‘শ্রমশ্রী’ ও ‘কর্মসাথী’ পোর্টালের মধ্যে তথ্য সংযুক্ত করে প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে।