• সংবিধান ও স্বাধীনতার ধারণাকে বিকৃত করার অভিযোগ...
    আজকাল | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক:  রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) শতবর্ষ উপলক্ষে সংঘ প্রধান মোহন ভাগবত আবারও হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে সরব হয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, হিন্দু রাষ্ট্র মানে হিন্দু নেশন নয়, বরং এমন এক রাষ্ট্র যেখানে কাউকে বাদ দেওয়া হবে না এবং সকলের জন্য ন্যায় নিশ্চিত হবে। কিন্তু ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভারতের সংবিধান প্রণেতারা স্পষ্টভাবে হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাই ভাগবতের বক্তব্য দেশ ও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর জন্য বিপজ্জনক।

    ভাগবত তাঁর ভাষণে বলেন, “হিন্দু রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক নেই।” একইসঙ্গে তিনি বর্ণপ্রথার বিরোধিতা করেন। কিন্তু সমালোচকদের মতে, হিন্দু রাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোই যখন বর্ণভিত্তিক বিভাজনের উপর দাঁড়িয়ে, তখন একদিকে বর্ণপ্রথার বিরোধিতা আর অন্যদিকে হিন্দু রাষ্ট্রের সমর্থন—এ দুটি অবস্থান একসঙ্গে চলতে পারে না।

    ভাগবত বলেন, আরএসএস সংগঠন হিসেবে নয়, তবে সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শাহী ঈদগাহ পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে যোগ দিতে পারেন। সমালোচকরা বলছেন, এটি স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর কৌশল। এই অবস্থান সরাসরি ১৯৯১ সালের Places of Worship Act-এর পরিপন্থী, যেখানে বলা হয়েছে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ধর্মীয় স্থাপনার চরিত্র অপরিবর্তিত থাকবে।

    ভাগবত দাবি করেন, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ছিল কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা, প্রকৃত স্বাধীনতা এসেছে ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধনের মাধ্যমে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতের জাতীয় চেতনা তখনই জাগ্রত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভাবনার বিকৃতি, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিতে স্বাধীন ভারত গড়ে ওঠে।

    শুধু ভাগবত নন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও  রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার দিনে বলেন, “রাম মানেই রাষ্ট্র, দেব মানেই দেশ।” সংবিধানের প্রতি শপথ নেওয়া একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য নজিরবিহীন। এদিকে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ১৯৫১ সালে সোমনাথ মন্দির উদ্বোধনে অংশ নিলেও বলেছিলেন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নীতি সর্বদা ব্যর্থ হবে। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলও একাধিকবার হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় তিনি বলেন, “হিন্দু রাষ্ট্র নিয়ে কোনো গুরুতর আলোচনা হতে পারে না।”

    ড. বি.আর. আম্বেদকর তাঁর Pakistan or Partition of India গ্রন্থে লিখেছিলেন, “হিন্দু রাজ হবে এক মহা বিপর্যয়, আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে একে প্রতিরোধ করতে হবে।” ইতিহাসে দেখা যায়, হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শীরা পর্যন্ত কখনও কখনও ভারতের সংবিধান-ভিত্তিক ঐক্য ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের দেওয়ান সার্বভৌমত্বের উৎস ভগবান পদ্মনাভ বলে দাবি করেছিলেন। তখন সাভারকর তাঁর পক্ষে দাঁড়ালেও, প্যাটেলের দৃঢ়তায় রাজ্য ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হয়।

    আজ যখন আরএসএস প্রধান হিন্দু রাষ্ট্রের ডাক দিচ্ছেন, তখন ইতিহাসের শিক্ষা স্মরণ করা জরুরি। সংবিধান, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র ভারতের শক্তি। সমালোচকদের মতে, ভাগবতের সাম্প্রতিক বক্তব্য মানুষকে বিভক্ত করার কৌশল এবং বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের হাতিয়ার। তাই ভারতের জনগণের দায়িত্ব এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সংবিধান ও স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনাকে রক্ষা করা।
  • Link to this news (আজকাল)