• জিডিপি পরিসংখ্যানে উচ্চ বৃদ্ধির দাবি, বাস্তবে কি ধোঁয়াশা?
    আজকাল | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক:  কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স অফিস (NSO) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের (এপ্রিল-জুন) জন্য জিডিপি-র প্রাথমিক অনুমান প্রকাশ করেছে। অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭.৮%, যা গত বছরের একই সময়ের ৬.৫% বৃদ্ধির তুলনায় অনেকটাই বেশি। এমনকি ২০২৪-২৫ সালের শেষ ত্রৈমাসিকের (Q4) ৭.৪% বৃদ্ধির থেকেও এটি বেশি।

    সরকারি এই ‘অপ্রত্যাশিত সাফল্য’-র মূল ভরসা পরিষেবা খাত বা তৃতীয় খাতের দ্রুত বৃদ্ধি। তথ্য অনুযায়ী, এ খাতের বৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯.৩%, যেখানে গত বছর তা ছিল ৬.৮%। তবে এর বিপরীতে শিল্প বা দ্বিতীয় খাতের বৃদ্ধি ৮.৬% থেকে কমে হয়েছে ৭.০%। কৃষি ও প্রাথমিক খাত সামান্য বৃদ্ধি দেখিয়েছে—২.২% থেকে বেড়ে হয়েছে ২.৮%।

    ক্ষেত্রভিত্তিক প্রবণতা- তথ্যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রবৃদ্ধি তীব্রভাবে কমেছে। যেমন— খনি ও খনিজ উত্তোলনে বৃদ্ধি ৬.৬% থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে -৩.১%। বিদ্যুৎ, গ্যাস, জল সরবরাহ ও অন্যান্য ইউটিলিটি পরিষেবায় বৃদ্ধি ১০.২% থেকে নেমে ০.৫%। উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং) খাতের বৃদ্ধি আগের মতোই স্থির থাকলেও, নির্মাণ খাত (কনস্ট্রাকশন) ১০.১% থেকে নেমে ৭.৬% হয়েছে। অন্যদিকে, বাণিজ্য, হোটেল, পরিবহণ, যোগাযোগ ও সম্প্রচার পরিষেবা খাতে বৃদ্ধি ৫.৪% থেকে বেড়ে ৮.৬% হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই এক খাতই জিডিপি বৃদ্ধির বড় অংশ বহন করছে।

    অফিসিয়াল নথিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, এই অনুমান তৈরি করা হয়েছে Benchmark-Indicator Method ব্যবহার করে, অর্থাৎ গত বছরের একই সময়ের তথ্যকে ভিত্তি ধরে নির্দিষ্ট কিছু সূচকের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়েছে। কিন্তু Annexure B-তে উল্লিখিত উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি সূচকগুলির বেশিরভাগই অর্থনীতির মন্দা প্রবণতা দেখাচ্ছে। ২২টি সূচকের মধ্যে মাত্র ৫টিতে উন্নতি দেখা গেছে— যেমন সিমেন্ট উৎপাদন, প্রধান সমুদ্রবন্দরে পণ্য ওঠানামা, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব ব্যয় (সুদ ও ভর্তুকি বাদে), মূলধনী পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি-আমদানি ব্যবধান।

    কিন্তু অন্তত ৭টি সূচক গুরুতর পতন দেখাচ্ছে— যেমন কয়লা উৎপাদন, ইস্পাত খরচ, বেসরকারি গাড়ি বিক্রি, বিমানবন্দরে পণ্য পরিবহণ, রেল যাত্রী কিলোমিটার, খনি খাতের IIP এবং বিদ্যুতের IIP। বাকি সূচকগুলির বৃদ্ধি মাঝারি হারে কমেছে। এই তথ্যগুলো ইঙ্গিত করছে যে শিল্প খাত তো বটেই, ভোগব্যয় ও পরিষেবা খাতেও প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধির ধারা দুর্বল। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠছে অনানুষ্ঠানিক খাতের পরিসংখ্যান নিয়ে। বর্তমানে জিডিপি অনুমানে সংগঠিত খাতের অল্প কিছু তথ্যকে ভিত্তি করে গোটা অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাণিজ্য ও পরিবহণ খাতে ই-কমার্সের ২৫% বৃদ্ধি ধরা হচ্ছে। অথচ ছোট দোকান, স্থানীয় বাজার, খুচরো ব্যবসা—যেখানে ৯০% মানুষ কাজ করে—তার পতন ধরা পড়ছে না।

    ফলে, সংগঠিত খাত যত বেশি বাড়ছে, অনানুষ্ঠানিক খাতের মন্দা ততটাই অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে। এর ফলে জিডিপি বৃদ্ধি কাগজে-কলমে অনেক বেশি দেখালেও, বাস্তবে কর্মসংস্থান ও আয়ের বৃদ্ধি খুবই সীমিত। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, capacity utilisation বা উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার এবং উপভোক্তা আস্থা সূচক—দুটিই খুব বেশি উত্থান দেখাচ্ছে না। ফলে শিল্পে নতুন বিনিয়োগ বা ভোগব্যয়ের তীব্র বৃদ্ধি হওয়ার সুযোগ কম। তবুও সরকারি হিসাব জিডিপি বৃদ্ধিকে বেশি  দেখাচ্ছে।

    অর্থনীতিবিদদের মতে, এই প্রবণতা নতুন নয়। নোটবন্দি, জিএসটি চালু হওয়া ও কোভিড-পরবর্তী সময়ে জিডিপি অনুমানের সঙ্গে বাস্তব সূচকের ব্যবধান আরও বেড়েছে। মূলত অনানুষ্ঠানিক খাতের তথ্যের অভাবই এই বিভ্রান্তির প্রধান কারণ। সরকারি হিসেবে বৃদ্ধি যতই আশাপ্রদ দেখাক না কেন, বাস্তব মাটির ছবিতে কর্মসংস্থানের ঘাটতি, দারিদ্র্য ও ভোগব্যয়ের মন্দাই স্পষ্ট। তাই অনানুষ্ঠানিক খাতের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ ছাড়া দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য বোঝা সম্ভব নয়। উচ্চ জিডিপি বৃদ্ধির দাবিও তাই প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে।
  • Link to this news (আজকাল)