শুল্ক-যুদ্ধের পাল্টা, ভারত-চীন-রাশিয়া নয়া অক্ষের সূচনা
বর্তমান | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি: নিছক এশিয়া নয়। সোমবার দিনভর আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ইউরোপের তাবৎ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলির শিরোনাম কমবেশি কাছাকাছি—মোদি-জিনপিং-পুতিনের একজোট হয়ে কড়া বার্তা ট্রাম্পকে। এই চর্চা ছাড়া উপায়ও নেই। কারণ, বেজিং থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে কিছু পাহাড় এবং সমুদ্রতটবর্তী তিয়ানজিন শহরে সোমবার বিশ্ব ক্ষমতায়নের নতুন সমীকরণের, নতুন অক্ষের সূচনা হল। রবিবার সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন সম্মেলনে যোগ দিয়ে নরেন্দ্র মোদি চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। জিনপিং এবং মোদি ঘোষণা করেন, ‘এই দুই প্রাচীন সভ্যতার দেশের মধ্যে মৈত্রী এবং সহযোগিতার নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হল।’ অপেক্ষা ছিল তারপরও। কারণ, রাশিয়া তখনও আসরে নামেনি। আর তাই সাত বছর পর মোদির সঙ্গে জিনপিংয়ের ওই বৈঠক যতটা না হাই ভোল্টেজ ছিল, তার থেকেও যেন সোমবারের একটি দৃশ্য গোটা বিশ্বের কাছে চমকপ্রদ হয়ে রইল। এদিন সম্মেলন স্থলে জি জিনপিং, নরেন্দ্র মোদি এবং ভ্লাদিমির পুতিনকে দেখা গেল কখনও হাতে হাত ধরে পরস্পরের সঙ্গে আলাপচারিতায় মত্ত। কখনও আবার ব্যক্তিগত আড্ডায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন।
কূটনীতিতে নিছক বৈঠক অথবা সিদ্ধান্ত নয়। অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ প্রতীক হল, সম্পর্কের উষ্ণতার প্রদর্শন। আর সবটাই ফটো এবং ভিডিওয়। সকাল থেকে বিশ্বজোড়া সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সেগুলিই ছড়িয়ে পড়ল। পুতিন অপেক্ষা করছেন মোদির জন্য। সম্মেলনে যাবেন একসঙ্গে। ডেকে নিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। নিজের লিমুজিনে। এখানেই শেষ নয়! গন্তব্যে পৌঁছনোর পরও তাঁরা গাড়ি থেকে নামছিলেন না। ৫০ মিনিট তাঁদের ওই একান্ত আলোচনা চলল গাড়ির মধ্যে। এরপর পৃথকভাবে সম্মেলন স্থলেও হল আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। মোদি এবং পুতিনকে দেখা গেল হাত ধরাধরি করে ঢুকছেন। এগিয়ে এসে তাঁদের স্বাগত জানাচ্ছেন জি জিনপিং। এসসিও সম্মেলনের মঞ্চের বাইরে তিন রাষ্ট্রপ্রধান দীর্ঘক্ষণ ব্যস্ত থাকছেন হাসি-ঠাট্টায়। পরস্পরের হাত ধরে। প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি শরীরি ভঙ্গি—আদতে স্পষ্ট বার্তা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। পুতিনের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠতার এই বার্তা দিয়ে মোদি সাফ বুঝিয়ে দিলেন, রাশিয়ার সঙ্গ তিনি ত্যাগ করছেন না। আর আপস করারও প্রশ্ন নেই। মোদি বলেছেন, ‘বহু সঙ্কটময় সময়ে রাশিয়া ও ভারত পরস্পরের পাশে থেকেছে।’ পুতিনের বক্তব্য, ‘ভারত রাশিয়ার স্বাভাবিক মিত্র। এই বন্ধুত্বের অবসান হবে না।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট অবশ্য পাল্টা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা একটা করেছেন। ট্রাম্পের সাফাই, ‘ভারতই আমাদের দেশে বেশি রপ্তানি করে। আমাদের থেকে নেয় কম। কাজেই ক্ষতিটা একতরফা।’ এমনকী ভারত শূন্য-শুল্কের প্রস্তাব দিয়েছিল বলেও দাবি করেছেন ট্রাম্প। কিন্তু এখন নাকি দেরি হয়ে গিয়েছে।
ট্রাম্পের ক্ষোভের আরও একটি কারণ কী? পুতিন যখন সব রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে গ্রুপ ফটো তোলার কথা বললেন, তখন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে কেউ ডাকেনি। তিনি ঠিক পিছনে। একাকী। চীনের মাটিতে দাঁড়িয়ে মোদি যেমন পহেলগাঁও হামলার বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করলেন, তেমনই পাকিস্তানের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘সন্ত্রাসের মদতদাতাদের যেন ক্ষমা না করা হয়।’ আবার সভ্যতা সংলাপ মঞ্চ নামক একটি নতুন নীতি নির্ধারণ প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রস্তাবও দিলেন। এসসিও’র যৌথ বিবৃতিতে নিন্দা করা হল পহেলগাঁও সন্ত্রাসের। মোদির আহ্বান, ‘প্রাচীন সভ্যতার দেশগুলি একজোট হয়ে নানাবিধ বিষয়ে আলোচনা করবে এই মঞ্চে।’ স্পষ্টতই এই প্রস্তাবের পিছনে পরোক্ষ বার্তা—মাত্র ৫৩৩ বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভারত, চীন, রাশিয়ার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। সুতরাং তিন প্রাচীন সভ্যতা হতে চলেছে নয়া পশ্চিমি সংস্কৃতির প্রধান প্রতিস্পর্ধী। নজর করার বিষয়, এই অক্ষের পাশে আসার বার্তা দিয়েছে ইরান, জাপানও। সুতরাং ছবিটা স্পষ্ট, ট্রাম্পের শুল্কনীতি বস্তুত পৃথিবীর নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ার সূত্রপাত ঘটিয়ে দিল।