ধর্ষণের মামলায় ফরেন্সিক রিপোর্ট আদালতে পেশ করতে সাত বছর!
আনন্দবাজার | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ধর্ষণের একটি মামলায় ফরেন্সিক রিপোর্ট তৈরি হয়ে গিয়েছিল ঘটনার দু’বছরের মধ্যেই। সেই রিপোর্টে স্পষ্ট হয়েছিল, ধর্ষণের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া নাবালিকার সন্তানের বাবার নামও। কিন্তু, এমন একটি স্পর্শকাতর মামলার ফরেন্সিক রিপোর্ট তৈরির পর থেকে আদালতে তা জমা দিতেই সাত বছর কাটিয়ে দিল বাগুইআটি থানার পুলিশ! বাস্তব পরিস্থিতি এটাই যে, বর্তমানে কৈশোর পেরিয়ে তরুণী হয়ে যাওয়া সেই নির্যাতিতা তাঁর সন্তানকে নিয়ে কলকাতা শহরে কার্যত মুখ লুকিয়ে বেঁচে রয়েছেন। আর অভিযুক্তেরা জামিনে মুক্ত রয়েছেন।
গত দশ বছর ধরে বারাসত পকসো আদালতে চলছে ওই মামলা। ২০১৫ সালে ওই কিশোরী ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করে বাগুইআটি থানায়। ২০১৭ সালে ফরেন্সিক রিপোর্ট তৈরি হয়ে যায়। আদালত সূত্রের খবর,ফরেন্সিক রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ওই কিশোরীর জন্ম দেওয়া এক পুত্রসন্তানের বাবা ওই বাড়ির গৃহকর্তা। অথচ, সাপ্লিমেন্টারিচার্জশিটের মাধ্যমে বাগুইআটি থানার পুলিশ সেই ফরেন্সিক রিপোর্ট আদালতে পেশ করেছে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে। যে ঘটনার পরে এমন একটি মামলায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি, মামলার বিশেষ সরকারি আইনজীবী গৌতম সরকারও মনে করছেন, ফরেন্সিক রিপোর্ট ঠিক সময়ে আদালতে জমা পড়েনি। তিনি বলেন, ‘‘ফরেন্সিক রিপোর্ট আরও আগে আদালতে পেশ করা উচিত ছিল তদন্তকারী সংস্থার। আমি অনেক পরে এই মামলায় যুক্ত হয়েছি।’’
এক দুপুরে বারাসত আদালতে সাক্ষী দিতে এসেছিলেন ওই তরুণী। দশ বছর আগের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এখনওচোখে জল আসে তাঁর। তাঁর কথায়, ‘‘দিদির মাধ্যমে ওই বাড়িতে কাজ করতে গিয়েছিলাম। প্রেমের নাটক করে প্রথমে বাড়ির মালিকের ছেলে আমার সঙ্গে শারীরিকসম্পর্ক করে। আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। জোর করে আমার গর্ভপাত করানো হয়। এর পরে আমাকে বাড়ির মালিক তাঁর কাজের জন্য কলকাতার বাইরে নিয়ে যান।সেখানে তিনি আমার উপরে শারীরিক অত্যাচার শুরু করেন। একাধিক বার ধর্ষণ করেন উনি। আমি আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। কিন্তু সে বার আমি গর্ভপাত করাব না বলে জেদ ধরেছিলাম।’’
তরুণীর পরিবারের অভিযোগ, অভিযোগ দায়ের করার আগে দু’-তিন বছর ধরে ওই কিশোরীর উপরে অত্যাচার করা হয়েছিল। ঘটনা ধামাচাপা দিতে বেহালার দিকে একটি নার্সিংহোমে তার সন্তান প্রসবের পরে জন্মের ভুয়ো শংসাপত্রও তৈরি করানো হয়। যেখানে সন্তানের মা হিসাবে বাড়ির মালকিনের নাম উল্লেখ করা হয়। তরুণীর অভিযোগ, ‘‘সন্তানের জন্মের পরে আমাকে তার থেকে আলাদা রাখা হত। এক সময়ে আমাকে সন্তান-সহ বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হয়।’’ এমন অশান্ত পরিস্থিতিতেই সেই সময়ে ওই তরুণীর দিদির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। যা নিয়ে নির্যাতিতার পরিবারের অভিযোগ, তরুণীর দিদিকে খুন করা হয়েছিল। যদিও সেই ঘটনার কোনও পুলিশি তদন্ত হয়নি বলেই জানান তাঁরা।
আদালত সূত্রের খবর, বাগুইআটি থানার পুলিশ ওই ঘটনায় ওই বাড়ির মালিক, তাঁর স্ত্রী ওছেলেকে গ্রেফতার করে। বেহালার সন্তোষ রায় রোডের একটি নার্সিংহোমে ভুয়ো জন্ম শংসাপত্র লেখা হয়। সেই নার্সিংহোমের মালিকও গ্রেফতার হন। একই অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয় তরুণীকে প্রসব করানো চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও। তিনি পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওই নার্সিংহোমেরমালিককে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে গ্রেফতার করা হয়নি। আমার এখানে কোন চিকিৎসক কী করেছেন, বলতে পারব না। আমার নার্সিংহোম এখন বন্ধ।’’ যদিও অভিযুক্ত চিকিৎসক বর্তমানে অসুস্থ বলেই জানান তিনি।
বাগুইআটির জ্যাংড়া এলাকার সুকান্তপল্লির সেই বাড়িতে গিয়ে এক দুপুরে একাধিক বার বেল বাজানো সত্ত্বেও দরজা খোলেননি জামিনে থাকা অভিযুক্তেরা। বাড়ির মালিক তথা ধর্ষণে অভিযুক্ত গৃহকর্তার নাম ধরে একাধিক বার ডাকাডাকি করেও সাড়া মেলেনি।
কিন্তু সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিতে কেন সাত বছর সময় লাগল? যে তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিক শুরুতে ওই মামলা করেছিলেন, ২০২৪ সালে তিনিই সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘আমি ওই তদন্তের পরে বদলি হয়ে যাই। ফরেন্সিক রিপোর্ট ২০১৭ সাল থেকে থানার মালখানায় পড়েছিল। ২০২৪ সালে বিষয়টি আমার নজরে আসার পরে আমি সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিই।’’