এই সময়: একই নাম, একই ঠিকানা, একই পরিচয়ের ভিত্তিতে কী ভাবে একাধিক ভোটার কার্ড ইস্যু করা হচ্ছে, তা নিয়ে কয়েক মাস আগে প্রথম প্রশ্ন তুলেছিল তৃণমূল। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা দেশের নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে দাবি করেছিলেন, অবিলম্বে এই সব ভুয়ো নাম বাদ দিতে হবে তালিকা থেকে। এ নিয়ে গত মার্চ মাসে দিল্লিতে ইসির দপ্তরে নির্দিষ্ট অভিযোগও জানান জোড়াফুল নেতৃত্ব।
কিন্তু বিহারের ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন বা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশনের (সার) পরেও প্রায় দু’লক্ষ এমন ভুয়ো নাম রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ তুলল তৃণমূল। তাদের প্রশ্ন, তা হলে এত ঘটা করে ‘সার’ করার মানে কী? তথ্য–পরিসংখ্যান দিয়ে তাদের দাবি, খসড়া ভোটার লিস্টে বিহারের ৩৯টি বিধানসভা কেন্দ্রে অন্তত ১ লক্ষ ৮৮ হাজারের মতো ‘ডাবল ভোটার’–এর হদিশ মিলেছে।
‘সার’–এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ইতিমধ্যে মামলা বিচারাধীন সুপ্রিম কোর্টে। সেখানে বারবার শীর্ষ আদালতের প্রশ্নের মুখে পড়েছে কমিশন। তৃণমূল, কংগ্রেস–সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দাবি, কমিশন আসলে কেন্দ্রের শাসকদলের ইশারাতেই কাজ করছে। তবে এ দিন ‘সার’ নিয়ে আরও গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। শুধু এর আইনি বৈধতা নয়, ‘সার’–এর কার্যকারিতা নিয়েও সংশয় প্রকাশের বিস্তর জায়গা রয়েছে বলে তাদের মত।
লোকসভায় তৃণমূলের সাংসদ মহুয়া মৈত্র সোমবার বলেছেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলই প্রথম এই ভুয়ো ভোটার নিয়ে অভিযোগ তুলেছিল এবং নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিল। যদি বিহারের ৩৯টি বিধানসভা কেন্দ্রেই এত সন্দেহজনক ভোটারের হদিশ মেলে, তা হলে কী হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের উচিত যাতে মানুষ স্বাধীন ও স্বচ্ছ ভাবে তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। সেটা তারা করছে না।’ কেন্দ্রীয় সরকার ও কমিশনের বর্তমান আধিকারিকদের বিরুদ্ধে তাঁর স্লোগান, ‘ভোট চোর, গদ্দি ছোড়’।
তথ্য তুলে ধরে জোড়াফুল নেতৃত্বের দাবি, বিহারের ৩৯টি বিধানসভা কেন্দ্রের খতিয়ানে দেখা যাচ্ছে ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬৪৩ টি ক্ষেত্রে ভোটারের নাম ও তাঁর আত্মীয়ের নাম দু’বার করে রয়েছে। এর মধ্যে আবার ১ লক্ষ ২ হাজার ক্ষেত্রে একই নামের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ভোটারের বয়সের ফারাক মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে।
৪০ হাজার ৭৮১টি ক্ষেত্রে বয়সের ফারাক ৬–১০ বছরের মধ্যে এবং ৪৫,৭৭৪টি ক্ষেত্রে এই ফারাক ১০ বছরের বেশি। অর্থাৎ ‘সন্দেহজনক ভোটার’ হিসেবে এঁদের ধরা হলে অন্তত ৩ লক্ষ ৭৬ হাজার ভোট সন্দেহজনক তালিকায় চলে আসছে। এই ভোটাররা বিভিন্ন বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটের ফল অদলবদল করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
এই তথ্যপ্রমাণ কাটাছেঁড়া করে তৃণমূল নেতৃত্বের আরও দাবি, এই প্রায় ১ লক্ষ ৮৮ হাজার ভোটারের মধ্যে ১৬,৩৭৫টি ক্ষেত্রে দু’জন ভোটারের নাম, আত্মীয়ের নাম এবং বয়স হুবহু এক। আর এঁদের ঠিকানাও প্রায় একই অথবা বাড়ির দূরত্ব বড়জোর এক কিলোমিটারের মতো। জোড়াফুল নেতৃত্বের বক্তব্য, এই ভোটারদের এপিক তো খুঁটিয়ে বের করা কমিশনের পক্ষে খুব কঠিন কাজ ছিল না।
তা হলে এই বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে কেন? তৃণমূল নেতৃত্বের নজরে এসেছে, ২৫ হাজার ৮৬২টি ‘ডাবল ভোটার’–এর ক্ষেত্রে ঠিকানা ছাড়া সংশ্লিষ্ট ভোটারদের বাকি সব তথ্য মিলে যাচ্ছে। এই সব তথ্য খারিজ করে বিহারের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) যুক্তি দিয়েছিলেন, শুধুমাত্র নাম, বয়স বা ঠিকানা ধরে যে ‘ডাবল ভোটার’–এর অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। এর জন্য একেবারে মাঠে নেমে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করা প্রয়োজন। }
বিহারের বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় একই নাম, ঠিকানা, আত্মীয়ের নাম ধরে একাধিক মানুষ থাকার প্রবণতা বেশি বলেও কমিশন যুক্তি দিয়েছিল। যদিও তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন যে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে ‘ডাবল ভোটার’–এর সন্দেহ থাকার যথেষ্ট অবকাশ আছে।
তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, ‘ভোটার তালিকায় কারচুপির প্রমাণ আবারও ফাঁস! তা হলে সার করে কী লাভ?’ তাদের যুক্তি, ‘গত ৬ মার্চ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনের কাছে ভুয়ো ভোটারদের ইস্যু নিয়ে অভিযোগ করে এবং তদন্তের আবেদন জানায়। এর জবাবে কমিশন ঘোষণা করে—সমস্ত ডুপ্লিকেট ভোটার নির্মূল করা হবে ৭ জুনের মধ্যে। অথচ বিহারের ৩৯টি বিধানসভা কেন্দ্রে আবার প্রায় ১,৮৭,৬৪৩ লক্ষ ডবল ভোটারের হদিশ মিলল! এটা শুধু অবহেলা নয়, বরং বিজেপির মদতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে কমিশনের স্পষ্ট কারচুপির প্রমাণ।’