জলাজমি এলাকায় অবাধ বিচরণ ওদের। খেত–খামারের আশপাশে, জঙ্গল এলাকায় জলাশয়ের কাছাকাছি জমজমাট বসতি। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত সেই বাঘরোল বা ফিশিং ক্যাট এবার হাজির একেবারে অন্য ভুবনে! রুখাশুখা এলাকা, মাইলের পর মাইল শিল্পাঞ্চল আর বসতি, ধুলো–ধোঁয়ার দূষণও তীব্র — এমন অঞ্চলকে কখনওই ফিশিং ক্যাটের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ধরা হয় না।
অথচ বিজ্ঞানীদের অবাক করে প্রথমবার তাদের উপস্থিতির প্রামাণ্য ছবি সামনে এসেছে পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুর–ফরিদপুর ব্লকের মাধাইগঞ্জ এলাকায়। ভারী শিল্পের কারখানা আর পরের পর কয়লাখনি ঘেরা এলাকায় বাঘরোলের উপস্থিতির প্রমাণে উচ্ছ্বসিত বিজ্ঞানীরা। কারণ, এতদিন বাংলার যে যে জেলায় বাঘরোলের দেখা মিলত, সেই পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, কলকাতা, উত্তর–দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে চাষাবাদের জায়গা ও জলাভূমি প্রচুর।
শহর কলকাতাতেও গাঙ্গেয় অববাহিকা, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি রয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি শিল্পাঞ্চল ও কয়লাখনি ঘেরা এলাকায় দেশের শিডিউল–১ তালিকাভুক্ত প্রাণীটির উপস্থিতি ওদের তুখোড় অভিযোজন ক্ষমতার নতুন দিশা খুলে দিচ্ছে — মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে মজার কথা, বাঘরোলের যে ছবি আচমকাই বঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে রাজ্য প্রাণীটির উপস্থিতির প্রথম প্রমাণ দিচ্ছে, সেটা তোলার লক্ষ্যে কিন্তু ওই এলাকায় ক্যামেরা ট্র্যাপ বসানো হয়নি। ডব্লিউডব্লিউএফ–এর উদ্যোগে পশ্চিম বর্ধমানে ৯টি ক্যামেরা ট্র্যাপ বসিয়ে ‘ইন্ডিয়ান গ্রে উলফ’ বা নেকড়ের বসতি সন্ধানের কাজ চলছিল। সেই প্রকল্পের কাজেই আচমকা, গত বছরের ৭ অক্টোবর রাতে মাধাইগঞ্জে ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়ে যায় পূর্ণবয়স্ক মাদি বাঘরোলের ছবি।
বিস্মিত হয়ে যান বিজ্ঞানী–গবেষকরা। কারণ, মাধাইগঞ্জের একদিকে কাঁকসা শিল্পাঞ্চল এবং অন্য দিকে অন্ডাল–পাণ্ডবেশ্বরের মতো খনি এলাকা। গাঙ্গেয় অববাহিকার আশপাশে থাকা বাঘরোল খনি–শিল্পাঞ্চলে বিচরণ করছে — সেই চমকপ্রদ প্রাপ্তির কথা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আইইউসিএন–এর (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজ়ারভেশন অফ নেচার) জার্নাল ‘ক্যাট স্পেশালিস্ট গ্রুপ’–এ।
সেই গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক তথা পশ্চিম বর্ধমানে চলা প্রকল্পের প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর অর্কজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘এর আগে জলাজমি ভরা পূর্ব বর্ধমানে ক্যামেরা ট্র্যাপ বসিয়েও বাঘরোলের সন্ধান মেলেনি। সেখানে দুর্গাপুর শহর থেকে মাত্র ২১ কিলোমিটার দূরে যে বাঘরোল থাকতে পারে, আমাদের ধারণা ছিল না। ওখানে একটু গ্রাম্য এলাকা, কিছু জঙ্গলের প্যাচ, স্থানীয়দের কাটা পুকুর রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, সেটুকু দিয়েই বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে বাঘরোল। খনি–শিল্পাঞ্চল এলাকা হলেও মাধাইগঞ্জে অন্তত বাঘরোলের মাছ বা পাখি–পতঙ্গ শিকার করে বাঁচতে সমস্যা হচ্ছে না। কাছে কিছু ক্যানাল রয়েছে, সম্ভবত সেটাও অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।’ গত অক্টোবরের পরেও মাধাইগঞ্জে একাধিক বার বাঘরোলের দেখা মিলেছে।