গণশৌচাগার অপ্রতুল, সুরক্ষা নেই নারী ও রূপান্তরকামীদেরও
আনন্দবাজার | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
পথে বেরোনোর আগে, শেষ মুহূর্তে বার বার বাড়ির শৌচাগারে যান মধ্যবয়স্কা মহিলা, যাতে গণশৌচাগারে যেতে না হয়। কেউ আবার জল খাওয়ার পরিমাণই কমিয়ে দেন। রাতবিরেতে মহিলা গাড়িচালক শহরের পথে ঘুরলেও খোলা পান না কোনও গণশৌচাগার। পোশাক বদলাতে গণশৌচাগারে গিয়ে যৌন নিগ্রহের শিকার হন রূপান্তরকামী। কখনও আবার কোনও যৌনকর্মীকে শৌচাগার ব্যবহারের ‘দাম’ চোকাতে হয় অন্য ভাবে!
খাস কলকাতার রাজপথে মহিলা এবং রূপান্তরকামীদের গণশৌচাগার ব্যবহারের বাস্তব পরিস্থিতি এমনই। যার বদল হয়নি বহু বছরেও। সম্প্রতি রোটারি সদনে এক অনুষ্ঠানে কলকাতার গণশৌচাগারের উপরে করা সমীক্ষার এমন ফলাফলই তুলে ধরল দুই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ‘সবর ইনস্টিটিউট’ এবং ‘আজ়াদ ফাউন্ডেশন’। একাধিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০০ জন পড়ুয়াকে দিয়ে ১৪২টি ওয়ার্ডের ৩৮৩টি গণশৌচাগারের উপরে করা এই সমীক্ষা ফের দেখাল, এ শহরে মহিলা ও রূপান্তরকামীদের জন্য গণশৌচাগার আজও কতটা অপরিষ্কার, অসুরক্ষিত এবং স্থানবিশেষে অপ্রতুলও।
ওই সমীক্ষা বলছে, এ শহরে ধনীদের এলাকায় গণশৌচাগারের সংখ্যা অধিক, বস্তি এলাকায় কম। কোনও গণশৌচাগারেই মহিলাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলার ব্যবস্থা, ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন, সন্তানকে স্তন্যপান করানোর মতো জায়গা নেই। এমনকি, বহুগণশৌচাগারে সাবান, জল, আলো, দরজায় ছিটকিনি, সুরক্ষিত পরিবেশটুকুও নেই। ফলে, দিনভর পথেঘাটে কর্মরতা মহিলারা হয় ঋতুস্রাবের দিন কাজে যান না, অথবা বাইরে শ্রমদান করা থেকে বিরত থাকেন। সমাজকর্মী এবং আজ়াদ ফাউন্ডেশনের তরফে দোলন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মেয়েদের শরীর ও শ্রমদানের উপরেও পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ খাটায় সমাজ। তাই আজও শ্রম ক্ষেত্রে মহিলাদের সংখ্যা কম, পারিশ্রমিকও কম। মেয়েদের শ্রমিক সত্ত্বাকে স্বীকৃতি দিতে সুরক্ষিত শৌচাগারের পরিকাঠামোর প্রয়োজন রয়েছে।’’ সমাজকর্মী সাবির আহমেদ বলছেন, ‘‘বিদেশিদের নিয়ে হেঁটে শহর দেখাতে বেরিয়ে শৌচালয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই গলা শুকিয়ে যায়। কারণ, অধিকাংশ অপরিচ্ছন্ন গণশৌচালয় ইউটিআই এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। হাওড়া-শিয়ালদহের মতো ব্যস্ততম জায়গাতেও মেয়েদের শৌচাগারের সংখ্যা যথাক্রমে ১৯ এবং ২৪টি। অর্থাৎ, অপ্রতুল পরিকাঠামোর কারণে পুরুষ-মহিলার পারিশ্রমিকের তফাতটাও বাড়ছে। পুরুষ নিরাপত্তারক্ষী থাকার কারণে অনেক শৌচালয়েই রাতে মহিলারা সুরক্ষিত বোধ করেন না।’’ তাই পরিকাঠামোর উন্নয়ন, গণশৌচালয় সংক্রান্ত মোবাইল অ্যাপ তৈরি, ঋতুস্রাব সংক্রান্ত ব্যবস্থা, স্টেশনে আরও গণশৌচালয়, মহিলা নিরাপত্তারক্ষীর ব্যবস্থা, রূপান্তরকামীদের জন্য সুরক্ষিত পরিবেশ-সহ একগুচ্ছ দাবি জানানো হয়েছে ওই সমীক্ষার রিপোর্টে।
তবে, দিন-রাত পথে কাটানো মহিলারা আদৌ কতটা গণশৌচালয়ের সুবিধা পান? আলোচনাসভায় যোগ দিয়ে ‘পিঙ্ক ক্যাব’ চালক অর্চনা মুন্ডা বলছেন, ‘‘২০১৯ সাল থেকে পিঙ্ক ক্যাব চালাচ্ছি। বহু বার রাতে গাড়ি নিয়ে ফেরার পথে একটা শৌচালয়ও খুঁজে পাইনি। প্রয়োজনে সময়ের আগেই ভাড়া না খেটে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। গাড়ি রেখে শৌচালয়ে গেলে পুলিশি প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছে। হাতে-পায়ে ধরে ছাড়া পেয়েছি।’’
সংস্কৃত কলেজের শিক্ষিকা সমতা বিশ্বাস আবার তুলছেন গণশৌচালয়ের মহিলা সাফাইকর্মীদের প্রসঙ্গ। তাঁর মতে, ‘‘যাঁদের জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে গণশৌচালয়ে, সেই সব সাফাইকর্মীকে আমরা সমাজের অংশ বলেই মানি না। নামমাত্র মাইনে পেয়ে, কোনও রকমে অ্যাসিড ছিটিয়েই শৌচাগার সাফাই করে থাকেন তাঁরা। এঁদের থেকে আর কত বেশি পরিষেবা আশা করতে পারি?’’ বিশেষ ভাবে সক্ষমদের গণশৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ এ শহরে কতটা, ওঠে সেই প্রশ্নও।
তবে, শুধু গণশৌচালয় তৈরিই কি সমাধান? বিশেষত, যেখানে সেটাই অপরাধ বা হিংসার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে? যেখানে রক্ষকই শোষকের ভূমিকায়? কুইয়র সমাজকর্মী এবং ‘স্যাফো ফর ইকোয়ালিটি’-র ম্যানেজিং ট্রাস্টি কোয়েল ঘোষের মতে, শৌচালয় ব্যবহারের অধিকার থেকেই বঞ্চিত রূপান্তরকামীরা। এক জন রূপান্তরকামী মহিলাকে মহিলাদের শৌচাগারে যেতে বাধা দেওয়া হয়, কারণ তিনি বহিরঙ্গে পুরুষ। আবার পুরুষদের শৌচাগারে গিয়ে যৌন নিগ্রহের শিকার হতে হয় রূপান্তরকামী পুরুষকে, যিনি শরীরে নারী। ‘‘রূপান্তরকামীদের জন্য পৃথক শৌচাগার হলেও নিস্তার নেই। কারণ সহজেই চিহ্নিত হয়ে সেটাও হেট-ক্রাইমের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।’’ — বলছেন কোয়েল।