• ভোটাধিকার নিয়ে রাহুলের যুদ্ধ যেন মহাত্মা গান্ধীর লড়াইয়ের প্রতিচ্ছায়া ...
    আজকাল | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভোটাধিকার রক্ষার প্রশ্নে আজকের ভারত এক অদ্ভুত ঐতিহাসিক প্রতিসাম্যের সামনে দাঁড়িয়ে। যেমন ১৮৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল প্রদেশে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয়দের সীমিত ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, তেমনই ২০২৫ সালে বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছে। আর এই পরিস্থিতিতেই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, রাজদ নেতা তেজস্বী যাদব ও সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য একত্রিত হয়ে নতুন এক ভোটাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।

    ১৮৯৪ সালে নাটাল অ্যাসেম্বলিতে ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি আইন সংশোধনী বিল’ আনা হয়েছিল ভারতীয়দের সীমিত ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য। সেই সময় যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে ভারতীয়রা ভারতে ভোটাধিকার ভোগ করে না, ফলে দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের ভোটাধিকার দেওয়া উচিত নয়। গান্ধীজী এই যুক্তিকে তীব্রভাবে খণ্ডন করেছিলেন এবং বলেছিলেন ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া মানে কর্মসংস্থান, সম্মান ও অস্তিত্ব কেড়ে নেওয়া।

    ২০২৫ সালে বিহারে নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) বিশেষ নিবিড় সংশোধনী (SIR) চালু করেছে। এর ফলে বহু ভোটারের নাম বাদ যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রথমে ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড গ্রহণযোগ্য দলিল হিসেবে ধরা হয়নি। পরে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে আধার যুক্ত হলেও বাকি ১১টি নথি অধিকাংশ সাধারণ মানুষের নাগালে নেই। ফলে লাখ লাখ মানুষের ভোটাধিকার বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, এটি আসলে ভোটার দমন ও শাসক দলের পক্ষে নির্বাচনী সুবিধা আদায়ের এক প্রক্রিয়া।

    ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কর্ণাটকের মহাদেবপুরা কেন্দ্রে ব্যাপক ভোট চুরির অভিযোগ তুলেছিলেন রাহুল গান্ধী। তিনি নির্বাচনী তালিকার লক্ষাধিক পৃষ্ঠার তথ্য তুলে ধরে দাবি করেছিলেন যে শাসক বিজেপি ভোট কারচুপির মাধ্যমে জয়লাভ করেছে। এরপর থেকেই তিনি ভোটাধিকার রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

    বিহারে ১৭ দিনের দীর্ঘ ভোটার অধিকারের যাত্রা শেষ হয় ১লা সেপ্টেম্বর পাটনায়। সমাবেশে রাহুল গান্ধী জোর দিয়ে বলেন—“ভোট চুরি মানে অধিকার চুরি, চাকরি চুরি, শিক্ষা চুরি, গণতন্ত্র চুরি এবং তরুণদের ভবিষ্যৎ চুরি।” তাঁর এই বক্তব্য গান্ধীজীর ১৮৯৪ সালের সতর্কবাণীর সঙ্গে যেন হুবহু মিলে যায়। অপজিশন নেতারা বিহারের SIR-কে অভিহিত করেছেন ভোট বন্দি নামে। গান্ধীজী নাটালের বিলকে বলেছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল আইন। দুই সময়ের মধ্যে ব্যবহৃত শব্দভাণ্ডার ভিন্ন হলেও মূল সুর একই—নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত।

    বিহারে এই আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিচ্ছেন। যেমন নাটালে গান্ধীজীর নেতৃত্বে সমস্ত ধর্ম ও শ্রেণির ভারতীয়রা একত্রিত হয়েছিলেন, তেমনি আজ বিহারেও সমস্ত শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মানুষ অংশ নিচ্ছেন। আন্দোলনে বিশেষ করে যুব সমাজের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তাঁদের বক্তব্য, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া মানে ভবিষ্যৎ কেড়ে নেওয়া।

    ভারতের সংবিধান ১৯৫০ সাল থেকে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছে। অথচ আজ সেই দেশেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নামে লাখ লাখ মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিকে রাহুল গান্ধী সরাসরি গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই প্রবণতা অক্ষুণ্ণ থাকে তবে ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গুরুতর আঘাতের মুখে পড়বে।

    নাটালের ১৮৯৪ সালের প্রতিরোধ ও বিহারের ২০২৫ সালের ভোটাধিকার সংগ্রামের মধ্যে বিস্ময়কর ঐতিহাসিক মিল পাওয়া যায়। গান্ধী যেমন বলেছিলেন ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া মানে অস্তিত্বকেই বিপন্ন করা, আজ রাহুল গান্ধীও দাবি করছেন ভোট চুরি মানে ভবিষ্যৎ চুরি। ইতিহাস যেন নতুন করে নিজেদের পুনরাবৃত্তি করছে।
  • Link to this news (আজকাল)