লোপ পেয়েছে দৃষ্টিশক্তি, অবলীলায় গাড়ি ও বাইক সারান নীলরতন মাজী
বর্তমান | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সজল মণ্ডল, রঘুনাথপুর: তিনি কি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অধিকারী। নাকি তিনি দিব্যদৃষ্টিতে সবকিছু দেখতে পান! রঘুনাথপুর থানার নতুনডি গ্রাম পঞ্চায়েতের দুরমট গ্ৰামের ১০০ শতাংশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী যুবক নীলরতন মাজীকে নিয়ে এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খায় এলাকায়। তিনি নামকরা গাড়ির মিস্ত্রি। আবার সাইকেল বা বাইক সারানোর ক্ষেত্রেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। নীলরতনের হাতের স্পর্শে বিকল সাইকেল, বাইক প্রাণ ফিরে পায়। অন্ধ হলেও আর পাঁচজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তির মতো ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেননি। নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তিনি এখন গাড়ি, বাইক, সাইকেলের কারিগর। তবে আক্ষেপ, সরকারের মানবিক ভাতা ছাড়া আর কোনওরকম সাহায্য তিনি পাননি। একাধিক দপ্তরে আবেদন করলেও কিছুই জুটেনি। বাঁকুড়া লোকসভার সাংসদ অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘বিষয়টি অবিশ্বাস্য। শুনেই অবাক হচ্ছি। অবশ্যই ওই যুবকের পাশে দাঁড়িয়ে সব রকম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হবে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নীলরতনের বাড়ি রঘুনাথপুর থানার একুঞ্জ গ্ৰামে। ১৯৮৯ সাল থেকে মামাবাড়ি দুরমটে থাকেন। সঙ্গে স্ত্রী ও দুই সন্তান, মামা ও দিদিমা রয়েছেন। মামাবাড়ির উঠোনে তাঁর গ্যারাজ। নীলরতন ছোট বেলা থেকেই চোখে কম দেখতেন। মামা বাড়ি থেকেই বিদ্যালয়ে যেতেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় দৃষ্টি শক্তি ধীরে ধীরে চলে যায়। তারপর আর স্কুল যাওয়া হয়নি। তখন থেকে মামা বাড়িতে থাকেন। ২০০৮ সালে গ্যারাজ দোকান খোলেন। কখনও হতাশ হননি। বাইক বা সাইকেলের গায়ে হাত বুলিয়েই বুঝে যান ত্রুটি কোথায়। কি ধরনের যন্ত্রাংশ লাগবে। এখনও তাঁর কাজ নিয়ে কোনও অভিযোগ আসেনি।
নীলরতন বলছিলেন, ‘এককুঞ্জা গ্রামে মা, ভাইয়ের পরিবার রয়েছে। ছোটবেলা থেকে মামা বাড়িতে থাকেন। বিয়ে করার পর সেখানেই দোকান খুলেছি।’ তাঁর আক্ষেপ, অন্ধ মানুষকে তো বেশি লোকে বিশ্বাস করেন না। তাই যারা বিশ্বাস করে তাঁরা দোকানে আসেন। তাতে দিনে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা উপার্জন হয়। কোনওরকম সংসার চলে যায়। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দপ্তরের লোনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনও সহযোগিতা মেলেনি। মামার বাড়িতে রয়েছি। আবাস যোজনায় আবেদন করলেও বাড়ি পাইনি।
যুবকের স্ত্রী রীতা মাজী বলেন, ‘অন্ধ জেনেও বিয়ে করেছি। বর্তমানে সুখেই সংসার করছি। গৃহবধূ হিসেবে যতটা পারি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। আমার স্বামী অন্ধ হলেও ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেনি। নিজে খেটে খাই। এটাই আমার কাছে গর্বের বিষয়।’
এলাকার বাসিন্দা শ্রীলোক মাজী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই নীলরতনের মধ্যে এক আলাদা প্রতিভা দেখতে পেয়েছিলাম। সেই সময় পায়ের শব্দ শুনেই বলে দিত কে আসছে। এখন যে কোনও গাড়ি খুলে তার সমস্ত পার্টস খুলে রেখে আবার পুনরায় সঠিক জায়গায় লাগিয়ে দিতে পারে।’ রঘুনাথপুর-১ নম্বর ব্লকের বিডিও রবিশঙ্কর গুপ্তা বলেন, ‘বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’
মহাভারতে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্রের বর্ণনা দিতে সঞ্জয়কে দিব্যদৃষ্টি নিতে হয়েছিল। নীলরতন কি তেমনই কোনও দৃষ্টির অধিকারী! বিস্ময়ের ঘোরে রয়েছেন রঘুনাথপুরবাসী। - নিজস্ব চিত্র