• জনসংযোগে সহায় হয়েছে, কিন্তু ‘নীলবাড়ির লড়াইয়ে’ জটিলতা বাড়াবে না তো? জল্পনা বাড়ছে পদ্মের ‘ফ্রিস্টাইল ব্রিগেড’ ঘিরে
    আনন্দবাজার | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • কেউ ‘ব্যাকস্ট্রোক’, ‘ব্রেস্টস্ট্রোক’, ‘বাটারফ্লাই’ সব জানেন। কেউ সাঁতারের পেশাদার ‘স্টাইল’ না জানলেও নদী-পুকুর সাঁতরে পেরোতে অনায়াস। কারও আবার নদী বা সমুদ্রের কাছে বাড়ি, তবু সাঁতারের সঙ্গে আলাপ নেই। ফলে বাস্তবের সাঁতার পারদর্শিতার নিরিখে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে এক বন্ধনীতে নেই। কিন্তু ‘রাজনৈতিক সাঁতারে’ আছেন। কারণ, দলে থাকলেও দলের দেখানো পথের পাশাপাশি এঁরা নিজস্ব ভঙ্গিতেও কর্মসূচির নদীতে ‘সাঁতার’ কাটেন। এঁরা বঙ্গ বিজেপির ‘ফ্রিস্টাইল ব্রিগেড’।

    এই তালিকায় অগ্রগণ্য ছ’জন।

    শুভেন্দু অধিকারী

    দলের বেঁধে দেওয়া কর্মসূচির পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে চলে শুভেন্দুর নিজস্ব কর্মকাণ্ড। কাঁথি, তমলুক, ঘাটালেই বেশি। তবে রামনবমী বা হনুমানজয়ন্তীর মিছিলে তাঁকে গোটা রাজ্য চষে বেড়াতে দেখা যায়। দলের ‘বন্‌ধ-বিরোধী’ নীতির উল্টো পথে হেঁটে তাঁর অনুগামীদের মাঝেমধ্যে স্থানীয় স্তরে ‘বন্‌ধ’ ডাকতে দেখা যায়। অরাজনৈতিক সংগঠনের নাম নিয়ে ‘নবান্ন অভিযানের’ ডাক দিতেও দেখা যায়। বিধানসভার অন্দরে তো তিনিই দলের ‘হাইকম্যান্ড’। কখনও ওয়াকআউট, কখনও ধর্না, কখনও বিধায়কদের নিয়ে মিছিল করে সোজা রাজভবন— সবই তাঁর নিজস্ব ‘ফ্রিস্টাইল’ রাজনীতি।

    বাস্তবে অবশ্য শুভেন্দু সাঁতার-টাতার জানেন না। তাঁর বসবাসের শহর কাঁথির অদূরেই বঙ্গোপসাগর। তা-ও সাঁতারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই বলেই জানাচ্ছেন বিরোধী দলনেতার ঘনিষ্ঠেরা।

    সুকান্ত মজুমদার

    অনেকের দাবি, তিনি তৃণমূলের কৌশল খানিকটা ‘হাইজ্যাক’ করেছেন। নিজের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরে পুরোপুরি পদ্মছন্দে রাজনীতি করেন না। বরং নানা ‘ফ্রিস্টাইল’ জনসংযোগে থাকেন। বলিউডের জনপ্রিয় গায়ককে এনে বর্ষবিদায়ের রাতে নিখরচায় অনুষ্ঠান দেখানো, রামনবমীতে নদীর ঘাটে সার সার প্রদীপ জ্বেলে অযোধ্যার আবহ তৈরি করা, বারাণসী থেকে পুরোহিত এনে ‘আত্রেয়ী আরতি’, মেলা বসানো বা আতশবাজির প্রদর্শনী। জেলার তৃণমূল নেতারা বলেন, ‘‘আমরা মেলা-খেলা-উৎসবে ব্যস্ত বলে বিজেপি অভিযোগ করে। সুকান্তবাবু সারা বছর নিজে কী করেন!’’

    শুভেন্দুর মতো সুকান্তও বাস্তবে সাঁতার জানেন না। তাঁর শহর বালুরঘাট আত্রেয়ীর তীরে। কিন্তু উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক সাঁতার শিখতে জলে নামেননি।

    দিলীপ ঘোষ

    রাজ্য সভাপতি থাকাকালীনও সমান্তরাল জনসংযোগ চালিয়ে গিয়েছেন। কখনও প্রাতর্ভ্রমণে। কখনও চা-চক্রে। কখনও রাস্তাঘাটে লাঠি খেলে। কখনও নিজের নির্বাচনী এলাকায় সত্যিকারের সাঁতার প্রতিযোগিতা করিয়ে। এখন তিনি সাংসদ নন। দলের কোনও পদেও নেই। দিঘা পর্বের পর থেকে দলীয় কর্মসূচিসমূহেরও বাইরে। কিন্তু নিজের মতো করে জনসংযোগে রয়েছেন। ২১ জুলাই খড়্গপুর গিরি ময়দানে ‘স্ব-উদ্যোগে’ শহিদ স্মরণ সমাবেশ করেছেন। স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করেছেন সাড়ম্বরে। সময়সুযোগ মতো চা-চক্রও চালিয়ে যাচ্ছেন ইতিউতি। তবে তাঁর ‘ফ্রিস্টাইল’ রাজনীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ দেখা গিয়েছিল কয়েক মাস আগে দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।

    তিনি কি সাঁতার জানেন? প্রশ্ন করায় দিলীপ-সিদ্ধ উত্তর, ‘‘খাল, বিল, পুকুর, নদী, সমুদ্র— সর্বত্র সাঁতার কাটতে পারি। ব্যাকস্ট্রোক, ব্রেস্টস্ট্রোক, বাটারফ্লাই— সব জানি।’’

    শান্তনু ঠাকুর

    সাঁতারে তিনি পটু। নিয়মিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। বাস্তবে ‘ফ্রিস্টাইল’ সাঁতার জানেন। রাজনীতিতেও সেই ‘স্টাইল’ নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করেন।

    তবে শান্তনুর পরিচয় শুধু রাজনীতিক হিসাবে নয়। তিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের পরিবারে জন্ম হলে ছোট থেকেই অনেক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলার অভ্যাস হয়ে যায়। আমি সে ভাবেই বড় হয়েছি। আমার ছেলেরাও সে ভাবেই রোজ অজস্র ভক্তের সঙ্গে মিলেমিশে বেড়ে উঠছে।’’ দলের সব কর্মসূচিতে না থাকলেও যেখানে থাকেন, বিজেপি কর্মীদের পাশাপাশি ভক্তবৃন্দের ঢল সঙ্গে থাকে। ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘে’র ব্যানারেও বছরভর নানা কর্মসূচি চালান। সেখানে সরাসরি রাজনৈতিক দলের নাম উচ্চারিত না হলেও মতুয়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য করণীয় নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দেন। যা প্রকারান্তরে ‘রাজনৈতিক বার্তা’ই বটে। বঙ্গ বিজেপির ‘সিএএ সহযোগিতা শিবির’ শুরু হয়েছিল শান্তনুর দফতরেই। দলের নির্দেশের অপেক্ষা করেননি।

    জ্যোতির্ময় মাহাতো

    পুরুলিয়ার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলে কান পাতলে তাঁর ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কথা শোনা যাচ্ছে। বিজেপির অধিকাংশ সাংসদ-বিধায়ক নিজেদের এলাকায় সে প্রভাব তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু জ্যোতির্ময়ের ডাকে সভা-মিছিল থাকলে পুলিশ ‘সে ভাবে’ বাধা দেয় না। নানা বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, লোকসভার স্পিকার বা বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থাকে নিরন্তর চিঠি পাঠান। সম্প্রতি কলকাতায় ‘পশ্চিমবঙ্গ ওবিসি অধিকার রক্ষা মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে ‘বিধানসভা ঘেরাও’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন। পুলিশ তাঁর মিছিল কলেজ স্ট্রিটের গণ্ডি পেরোতে দেয়নি। কিন্তু ধস্তাধস্তি, ধরপাকড়, গ্রেফতারে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছিলেন।

    পুনশ্চ: বাস্তবের সাঁতারও ভালই জানেন।

    রাজু বিস্তা

    দার্জিলিঙের দু’বারের সাংসদ রাজু আপাতদৃষ্টিতে রাজ্য রাজনীতিতে কোনও চর্চিত নাম নন। কিন্তু পাহাড়ের রাজনীতিতে আপাতত বিজেপির জন্য তিনিই শেষ কথা। সেখানে বিজেপি তাল মেলায় রাজুর তালে। দলের পদাধিকারী থেকে বিধানসভায় প্রার্থী নির্ভরশীল রাজুর ইচ্ছার উপরে। শোনা যায়, রাজু সে সব স্থির করেন বিমল গুরুং, রোশন গিরি, মন ঘিসিংদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে। তাঁর নির্দেশে কখনও পাহাড়ের নেতা সরাসরি কলকাতা পৌঁছোন বিজেপির রাজ্য সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে। তিনি নিজেই কখনও সমতলে নেমে সটান হাজির হন সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য সকাশে।

    পাহাড়ের বাসিন্দা রাজু কি বাস্তবের সাঁতার জানেন? জানলে ‘বোনাস’। না জানলে ক্ষতি নেই।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)