• তসলিমার পর এ বার বাধা জাভেদ আখতারকে, ‘গণতন্ত্রের ক্ষতি’, মত সুমন-কৌশিকদের
    আনন্দবাজার | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • খুবই সাধারণ এক আলোচনাসভা। বিষয় ‘হিন্দি সিনেমায় উর্দু’। বিশদে বলতে গেলে, ভারতীয় সিনেমায় উর্দু ভাষার ভূমিকা। আয়োজক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উর্দু অ্যাকাডেমি। সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল খ্যাতনামী গীতিকার তথা কবি জাভেদ আখতারকে। এতে প্রবল আপত্তি তোলে দু’টি ইসলামি সংগঠন জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দ (কলকাতা শাখা) এবং ওয়াহইন ফাউন্ডেশন। কলকাতার মতো শহরে স্বভাবতই এ নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনুষ্ঠানে আসবেন না বলে জানান জাভেদ। এই প্রসঙ্গে কী বলছে বাংলার শিল্পীমহল? আনন্দবাজার ডট কম যোগাযোগ করেছিল শহরের দুই নাট্যব্যক্তিত্ব— সুমন মুখোপাধ্যায় ও কৌশিক সেনের সঙ্গে। এই ঘটনায় তাঁদের কী প্রতিক্রিয়া?

    নাট্যকার-অভিনেতা ও চিত্রপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “এ রকম ঘটনা আগেও কলকাতায় ঘটেছে। তসলিমা নাসরিনের বই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আমার মনে হয়, এমন ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এ রকম ঘটনা যত ঘটতে থাকবে, তত আমাদের গণতন্ত্রের উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়বে। যে কোনও ধর্মীয় মৌলবাদই যে কোনও সমাজ-সংস্কৃতি ও দেশের জন্য বিপজ্জনক। এই যে ‘ব্যান কালচার’, কেউ সমালোচনা করলেই তাকে ‘ব্যান’ বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়ার যে চল, এতে বোঝাই যাচ্ছে যে মানুষের অসহিষ্ণুতা কতটা বেড়ে গিয়েছে। মৌলবাদী সংগঠনগুলি যে ভাবে উচ্চকণ্ঠে ধর্মীয় বিভেদের বার্তা ছড়াচ্ছে, তা যে কোনও সমাজের জন্যেই ক্ষতিকর।”

    কিন্তু এতে তো গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে খারাপ বার্তা যাচ্ছে! মানলেন সুমন। তাঁর কথায়, “জাভেদ আখতারের মতো শিল্পীকে যে কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে দেওয়া গেল না, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এর শিকার সবাই হবে। যারা বাধা দিল, তারাই জিতে গেল! আমরা, নাগরিক সমাজ কিছুই করতে পারলাম না। অন্যান্য প্রদেশে এমন ঘটনা তো ঘটছেই বহু দিন ধরে। কলকাতার মানুষের সাংস্কৃতিক একটা পরিমণ্ডল ছিল, উদারতা ছিল, চেতনা ছিল— সেই পুরোটাই ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু।”

    তিনি আরও যোগ করলেন, “কয়েকটি নাটকের দল, যারা আরজি করের প্রতিবাদে ছিল, তারা সরকারি হল পায় না। এ রকম তো আমাদের নাট্য পরিমণ্ডলেই ঘটছে। তোমার সমালোচনা কেউ করলে, তার উপর সরকারি কোপ পড়ছে, এ ঘটনা তো ঘটছে। শিল্পীদের এই সময় একসঙ্গে, একজোট হয়ে থাকা উচিত। কিন্তু সেটাও তো এখন সম্ভব হচ্ছে না। এখন রাজনৈতিক মেরুকরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শিল্পীরাও রাজনৈতিক দলের অংশ হয়ে গিয়েছেন। ফলে আরও সমস্যা। তাঁরা বলবেন কী?”

    একই মত নাট্যনির্দেশক-অভিনেতা কৌশিক সেনেরও। তিনি বলছেন, “জাভেদ আখতার এমন একজন মানুষ, যিনি শুধু ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধেই নয়, একই ভাবে হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধেও সরব। তিনি যথাযথ অর্থে নাস্তিক, বুদ্ধিজীবী। সেই কারণে, আমার মনে হয়, এই ধরনের মানুষকে বাধা দিলে, আখেরে একটা বড় ক্ষতি হয়। পরবর্তী কালে উনি যখন হিন্দু মৌলবাদের সমালোচনা করবেন, তখন যদি আমরা সেটাকে সমর্থন করি, আর এটাকে (ইসলামি মৌলবাদের সমালোচনা) সমর্থন না করি, তা হলে একটা ফাঁক তৈরি হয়। পরিষ্কার বলছি, আমাদের দেশের হিন্দুত্ববাদীরা এবং ভারতীয় জনতা পার্টি সেই সুযোগ পুরোপুরি নেবে। এ ক্ষেত্রে, আমি মনে করি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব দেখা গেল। তারা প্রমাণ করতে পারত, যে তারা কোনও ধরনের মৌলবাদই বরদাস্ত করে না। ফলে, এটা খুব ভুল এবং অন্যায় কাজ হল বলে মনে করি।” তাঁর কথায়, “জাভেদ আখতারের মতো মানুষ একটা চাপে পড়ে আসতে পারলেন না। এ বার এই ধরনের মানুষেরা তো হারিয়ে যাবেন। আমি মনে করি, সরকারের পাশাপাশি, এটা আমাদের যে এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবী-শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তাদেরও চরম ব্যর্থতা।”

    কৌশিক আরও বললেন, “আমরা যে লাগাতার বলে চলি, ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, যে যাঁর ধর্মাচরণ করতে পারেন। এটা একটা সাজানো গৎ, নিরাপদ থাকার একটা উপায়। আমরা সব কিছু নিয়ে সমালোচনা করতে পারি, ধর্মের ক্ষেত্রে আমাদের একটা ভয়-ভীতি কাজ করে। এ ক্ষেত্রে, রাজ্য বা সরকারের এই বিষয়টা শক্ত হাতে সামলানো উচিত। অবশ্যই ধর্ম একজনের ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু সেটা যখন সমষ্টিগত ভাবে সমাজের ভিতরে একটা বিভাজন তৈরি করছে, ক্ষতি করছে, সেটা কোনও ধর্মের ক্ষেত্রেই সহ্য করা উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি কড়া পদক্ষেপ না করে, সারা ক্ষণ যদি ভোটের কথা মাথায় রেখে কাজ করে, তা হলে সমূহ বিপদ। দেশের গণতন্ত্রের ক্ষতি।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)