• একশোয় পা উত্তমকুমারের! আজও কেন তিনিই মহানায়ক?
    প্রতিদিন | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: উত্তমকুমার (Uttam Kumar) রবীন্দ্রসংগীতের মতো। কোনওদিন বাঙালির কাছে ফুরোবেন না। যত পুরনো হচ্ছেন, ততই তিনি সুরভিত আমাদের নস্টালজিয়ায়। ইংরেজ কবি জন কিটসের ভাষায় তিনি ‘বিডেড বাবলস উইঙ্কিং অ্যাট দ্য ব্রিম।’ অর্থাৎ উত্তম আজও মহার্ঘ শ্যাম্পেনের ফেনা। এবং আজ তেসরা সেপ্টেম্বর ১০০-পা উত্তমের রমণীয় রোমান্টিকতা আমাদের কল্পনার পানপাত্রের কিনারে এখনও চোখ মারছে, শ্যাম্পেনের ঝিলমিল ফেনার মতো।

    উত্তমকুমারকে নিয়ে ‘নায়ক’ ছবিটা করার পরে সত্যজিৎ রায়কে খোঁচা মারা প্রশ্ন করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত কম্প্রোমাইজ করলেন? উত্তমকে নিলেন? উত্তরে সত্যজিতের দুর্বার দৈববাণী : বাংলা সিনেমায় আগে কোনও উত্তম হয়নি। পরেও হবে না। উত্তমই তো ‘নায়ক’। তাকে ভেবেই ছবির স্ক্রিপ্ট লিখেছি। আর কাকে নেব? উত্তম থাকতে? এ বছরের আজ থেকে আগামী বছরের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে উত্তমকুমারের ১০০তম জন্মদিনের পালন উৎসব। সারা বিশ্ব জুড়ে যেখানেই বাঙালি, সেখানেই হবে উত্তম ১০০-র স্মরণ, বরণ, নিবেদন। সুদূরবীক্ষণেও কি ধরা পড়ছেন এমন কেউ যিনি কোনওদিন দখল করতে পারেন উত্তমের সিংহাসন ও আবেদনের ব্যাপ্তি? অসম্ভব সে অসম্ভব! উত্তমকুমার সম্বন্ধে দুটি শব্দ তর্কাতীত : ক্ষণজন্মা। তর্কাতীত। শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে!

    কেন উত্তম ১০০-এ পা রেখে, ৪৫ বছর আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে উধাও হয়ে গিয়েও, আজও এমন নিরন্তর আইকন? কেন আজও নিটোল নায়ক? কেন বাঙালির মনকেমনে উত্তমের মহিমারেখায় এতটুকু শ্যাওলা পড়েনি? অকাট্য উত্তর : উত্তমের মতো সাবলীল, বিশ্বাস্য, বর্ণময় বাঙালি আর তো পেলাম না আমরা যিনি যে দৃশ্যেই পর্দায় আসেন, কেড়ে নেন পরিসর, ছিনিয়ে নেন মন, বুঝিয়ে দেন অভিঘাত। এমনকী, ছবি বিশ্বাসকেও বলতে শুনেছি, উত্তম আমার কাছ থেকেও কেড়ে নিতে পারে দৃশ্য। উত্তম-সুপ্রিয়ার ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেছি। মনে পড়ে বিশাল কাঠের দরজা খুলতেই লিভিং রুমের শেষে, বিশাল দেওয়াল জুড়ে, তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টারপিস।

    ক্যামেরায় তোলা ছবি। মেঝেতে কার্পেটের উপর হেলান দিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে, আমাকে হিপনোটাইজ করে, উত্তম হাসছেন তাঁর ‘কিলার’ হাসি। পরনে গিলে করা পাঞ্জাবি। ধুতির কোঁচা ফুলের মতো ছড়িয়ে আছে কার্পেটের উপর। আমার মুগ্ধতা আটকে থাকে দেওয়ালের গায়ে ওই ছবিটায়, যতক্ষণ না উত্তম নিজে বেরিয়ে আসছেন বাঁ ধারে তিনটি সারিবদ্ধ দুধসাদা, মুকুর উজ্জ্বল একটি দরজা খুলে। তিনি পরে আছেন পাঞ্জাবি। বুকের উপর আলগা হিরের বোতামের ঝিলিক। মুখে গত রজনীর প্রলেপ। চুলে চিরুনি পড়েনি। সচেতন অযত্নের বিন্যাস বাড়িয়েছে তাঁর নিজস্ব হেয়ার স্টাইলের বিভা। আমি আরও একবার নিশ্চিত, উত্তমের মতো সুন্দর বাঙালি আমি দেখিনি। ব্যাকরণ-বিশুদ্ধ, কান্তিশাস্ত্র-স্বীকৃত সৌন্দর্য নয়। উত্তম সুন্দর স্বয়ং ঈশ্বরের অহংকারী আর্ষ প্রয়োগে।

    উত্তমের এই স্বাভাবিক সৌন্দর্যে, আবেদনে এমন একটা নিখাদ বাঙালিত্ব, যা আমাদের মায়া, মমতা, ভালোবাসা ও বিশ্বাসে টান দেয়। উত্তম যে ভূমিকাতেই থাকুন, ক্রিশ্চান ধর্মযাজক থেকে ব্যারিস্টার থেকে আটপৌরে বাড়ির বড় দাদা থেকে সুচিত্রা সেনের প্রেমিক থেকে স্মৃতিভ্রষ্ট স্বামী, তিনি সব সময় আমাদের বাড়ির ছেলে। এটাই উত্তমের ম্যাজিক রিয়েলিটি। বাঙালি মা চায় উত্তমের মতো ছেলে। বাঙালি বোন চায় উত্তমের মতো দাদা। বাঙালি মেয়ে চায় উত্তমের মতো প্রেমিক। বাঙালি বউ চায় উত্তমের মতো স্বামী। বাংলা সিনেমা উত্তমের মতো অবতারকে একবারই পেয়েছে। আর কখনও পাবে না, এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।

    উত্তমকুমার একটা খাঁটি ব্যাপার অনুভব করেছিলেন। এবং সেটাও তাঁর সুপার সাফল্যের কারণ। তিনি সিনেমায় চাইতেন গল্পের জোর। আমাকে একবার বলেছিলেন, চিত্রনাট্যে শিরদাঁড়ার ক্ষমতা না থাকলে সিনেমা চলবে না। আমি সেই কারণে বড় সাহিত্যিকদের গল্প নিয়ে কাজ করতে চাই। যেমন ধরো শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, অচিন্ত্য। কিংবা এমন ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করেছি যাঁরা গল্পের স্ট্রেন্থ বুঝতে পারেন। গল্পের ভিতরটা ফাঁপা হলে ছবি চলবে না। আজকাল ক্রমশই দেখছি গল্পের মধ্যে তেমন কিছু বলার থাকে না। মনে রাখার মতো মুহূর্ত থাকে না। তখন খুব কষ্ট হয়।
    উত্তমকুমারকে ইন্টারভিউ করেছি বেশ কয়েকবার। তাঁর নায়িকাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ উত্তম। সুচিত্রা সেনকে সব সময় রমা। কখনও সুচিত্রা নয়। রমার সব থেকে বড় গুণ হল, কখনও ওভার অ্যাক্টিং করে না। আর একটা বড় গুণ হল, ওর মুখটা এত সুন্দর যে কোনও অ্যাঙ্গেল থেকে থেকে ওকে ভালো দেখায়। সুচিত্রা সেনের প্রেমে পড়ে আছে বাংলার সব পুরুষ। যারা সৌমিত্রের ফ্যান, তারাও। আপনি পড়েননি আপনার রমার প্রেমে? উত্তম বললেন, পড়েছিলাম তো। রমার প্রেমে না পড়ে থাকা যায়? রমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করেনি? উত্তমের উত্তর, হ্যাঁ করেছে। আমি জানতে চাই, তা হলে? উত্তম বললেন, রমা একটা মারাত্মক কথা বলেছে। তাঁর বিশ্বাস, ‘তুমি আমি এক সঙ্গে থাকলে আমাদের ছবি আর কেউ দেখতে আসবে না। আমাদের মধ্যে যে রোমান্সটা আছে, সেটা দূরত্বের দান।’

    উত্তম সুচিত্রার সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, পারস্পরিক নির্ভরতার একটা ছবি ফুটে আছে মনের মধ্যে। সেটা এই লেখার শেষে একটু না বলে পারছি না। গৃহদাহ ছবির শুটিং চলছে কলকাতার স্টুডিওতে। অচলার ভূমিকায় সুচিত্রা। অচলাদের দোতলা বাড়ি তৈরি হয়েছে স্টুডিওর মধ্যে। তখন এই রকমই হতো। অচলার জীবনে দুই পুরুষ। একজন কলকাতার উত্তমকুমার। অন্য জন বোম্বের প্রদীপকুমার। ঘটনা ঘটছে অচলার বাড়িতে। দৃশ্যে উপস্থিত অচলার বাবা পাহাড়ী স্যান্যাল, উত্তম, প্রদীপ। সুচিত্রা একটা ট্রেতে চা নিয়ে ঢুকছেন। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বললেন। আমি দোতলার সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে দেখছি। ডিরেক্টর বললেন কাট। দৃশ্য শেষ হল। এবার ডিরেক্টর কাঁচুমাচু করে হাত কচলে সুচিত্রাকে বললেন, ম্যাডাম, একটা রিটেক নেব। কেন? আকাশ থেকে পড়লেন সুচিত্রা। ম্যাডাম, মনে হচ্ছে আপনার কথাগুলো আর একবার নিতে পারলে … এবার সুচিত্রা উত্তমের দিকে তাকিয়ে, কী গো, কোনো ভুল হয়েছে? উত্তম এবার পরিচালককে, কোনও রিটেকের দরকার নেই। সুচিত্রা উত্তমের কোলে মাথা রেখে তক্তার ওপরে ক্লান্তভাবে শুয়ে পড়েন। উত্তম হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে থাকেন। পাহাড়ীর মুখে মৃদু হাসি। তিনি চোখ বুজে ধ্যানস্থ হন। ধীরে ধীরে কক্ষ ত্যাগ করে প্রদীপ বাইরে বেরিয়ে আসেন। উত্তম সুচিত্রা পাহাড়ী প্রদীপ, কেউ নেই এঁরা। আছে গৃহদাহ ছবির ওই দৃশ্যটা। আর আছে আমার স্মৃতিতে মন কেমনের পান্ডুলিপি। কত পুরনো। কিন্তু ধূসর হয়নি এতটুকু!
  • Link to this news (প্রতিদিন)