• মণিপুরে কুকি-জো জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে ‘অপারেশন স্থগিত’ চুক্তি নবীকরণের পথে কেন্দ্র ...
    আজকাল | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: মণিপুরে চলমান অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে কুকি-জো জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘সাসপেনশন অব অপারেশন্স’ (SoO) চুক্তি নবীকরণের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। ৩ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এই বৈঠক শেষ হওয়ার কথা আজ, ৪ সেপ্টেম্বর। নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার এই চুক্তি নবীকরণের দিকেই এগোচ্ছে। রাজ্যের বিভিন্ন মেইতেই সংগঠন বারবার দাবি জানিয়ে এসেছে, এই চুক্তি বাতিল করতে হবে। তাদের অভিযোগ, কুকি-জো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি SoO-র নিয়ম ভেঙে চলেছে এবং ২০২৩ সালের মে মাস থেকে শুরু হওয়া জাতিগত সংঘর্ষে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। মেইতেই সংগঠনগুলির মতে, যুদ্ধবিরতি কার্যত জঙ্গিদের আরও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

    ৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে দুপুর বারোটা নাগাদ কুকি-জো কাউন্সিল (KZC)-এর নেতারা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে বিকেল তিনটের দিকে SoO-ভুক্ত কুকি-জো সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চলে। যদিও আলোচনায় চূড়ান্ত সমাধান হয়নি, সূত্রের খবর অনুযায়ী, উভয় পক্ষ একটি প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছেছে এবং নবীকরণে সই করা হবে।

    এই বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে নেতৃত্ব দেন রাজেশ কাম্বলে, জয়েন্ট ডিরেক্টর (নর্থ-ইস্ট), এবং এ. কে. মিশ্র, যিনি উত্তর-পূর্বের জন্য কেন্দ্রের উপদেষ্টা ও আলোচক। মণিপুর সরকারের পক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ অশুতোষ কুমার এবং রাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তরের  শীর্ষকর্তা অশোক। তবে রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে মণিপুর সরকারের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা হয়েছে।কুকি-জো পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নেন কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (KNO) ও ইউনাইটেড পিপল’স ফ্রন্ট (UPF)-এর চারজন করে প্রতিনিধি। নবীকরণের চুক্তিতে তাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের জয়েন্ট সেক্রেটারিও সই করবেন বলে জানা গেছে।

    কুকি-জো সংগঠনগুলি নবীকরণের পাশাপাশি মণিপুর থেকে পৃথক একটি প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের দাবি আবারও তুলেছে। ২০২৩ সালের সংঘর্ষের পর থেকেই এই দাবি প্রবল হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক দাবি নিয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে কেবলমাত্র যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বৃদ্ধি পর্যন্ত। এই চুক্তির সময়ে রাজনৈতিক গুরুত্বও প্রবল। কারণ, চলতি মাসেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মণিপুর সফরের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি প্রতিবেশী আসামে যাওয়ার কথা। যদি মণিপুর সফর নিশ্চিত হয়, তবে এটি হবে মে ২০২৩-এ শুরু হওয়া ভয়াবহ জাতিগত সংঘর্ষের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর।

    ২০২৩ সালের মে মাস থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ২৬০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন, এবং প্রায় ৬০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। এখনও বহু মানুষ গাদাগাদি করে শিবিরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। রাজ্য কার্যত দুই সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকে মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে। এমতাবস্থায়, SoO চুক্তির নবীকরণ কেবল নিরাপত্তা বা শান্তির প্রশ্ন নয়, বরং আসন্ন প্রধানমন্ত্রী সফরের প্রেক্ষাপটে তা রাজনৈতিক বার্তাও বহন করছে।

    মণিপুরের বর্তমান সংকটকে বোঝার জন্য SoO চুক্তি কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, বরং রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। কুকি-জো সংগঠনগুলো দাবি করছে যে তাদের অস্ত্রবিরতির আওতায় রাখা উচিত, কারণ এটি অন্তত একটি অস্থায়ী শান্তি বজায় রাখছে। কিন্তু মেইতেই সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে, এই চুক্তির ফলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে এবং সহিংসতায় পরোক্ষভাবে উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে মণিপুরের সমাজে এক ধরনের গভীর অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। 

    বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্র সরকার একদিকে শান্তি আলোচনাকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে, অন্যদিকে মেইতেই সমাজের ক্ষোভকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারছে না। এই দ্বন্দ্ব মণিপুরের রাজনৈতিক সমীকরণকে আরও জটিল করেছে। রাজ্য প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীও ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছে, কারণ সামান্য সিদ্ধান্তগত ভুলই নতুন করে সহিংসতা উসকে দিতে পারে। তাই SoO নবীকরণের  সিদ্ধান্ত শুধু একটি কাগুজে স্বাক্ষর নয়, বরং মণিপুরের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ।
  • Link to this news (আজকাল)