• স্বপ্নাদেশে কুড়িয়ে আনা কাঠামোয় দুর্গাপুজো, সালকিয়ার ঢ্যাং বাড়ির দেবী আরাধনার বিশেষত্ব কী?
    প্রতিদিন | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • অরিজিৎ গুপ্ত, হাওড়া: এক কাঠের কর্মীর বাড়িতে দুর্গা প্রতিমার কাঠামো ভেঙে জ্বালানি তৈরি হচ্ছিল। জমিদারকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে ভাঙা কাঠামো উদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছিলেন দেবী। তখন থেকেই নাকি শুরু হয়েছিল সালকিয়ার ঢ্যাং বাড়ির পুজো। গত দেড়শো বছরের রীতি মেনে এখনও বিসর্জনের পর নদী থেকে ফিরিয়ে আনা হয় সেই কাঠামো।

    হাওড়ার সালকিয়ার ব্যানার্জি বাগানের ঢ্যাং পরিবারের পূর্বপুরুষ শ্রীরাম ঢ্যাং ছিলেন রাজহাটির জমিদার। ঢালাইয়ের কারখানা তৈরির জন্য সালকিয়াতে বসবাস শুরু করেন। বাড়ির কিছু দূরেই এক বস্তিতে নাকি কাঠের কর্মীর বাড়িতে দুর্গাপ্রতিমার কাঠামোটি ভেঙে জ্বালানির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেই কাঠামো বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন শ্রীরাম। এবার ১৫২তম বছরে পড়ল ঢ্যাং বাড়ির পুজো।

    একচালায় ডাকের সাজ দেবীর। অষ্টমীর আরতি ও সন্ধিপুজোর পর বাড়ির মহিলাদের নিয়ে ধুনো পোড়ানো রীতি চলে। লুচি, নাড়ু, মিষ্টি ও ফল দিয়ে দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয়। পায়রা ওড়ানোর রীতি বহু বছর আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে দেড়শো বছরের পুরনো নিয়ম মেনে এখনও দেবীর বিসর্জনের পর কাঠামো পুনরায় নিয়ে আসা হয় বাড়ির মন্দিরে।

    পরের বছর জন্মাষ্টমীতে গঙ্গার পাড় থেকে মাটি নিয়ে এসে কাঠামো পুজো করে ফের শুরু হয় প্রতিমা গড়ার কাজ। আর সেদিন থেকেই কালীপুজো পর্যন্ত বাড়ির সদস্যদের শুধুমাত্র নিরামিষ ও মাছ খাবার নিয়ম রয়েছে। পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা বলেন, “দুর্গাপুজোয় পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন মিলে গোটা বাড়িটা প্রায় শতাধিক লোকের উপস্থিতিতে গমগম করে। পুরনো রীতি এখনও বহন করছি আমরা। এটাই বজায় থাকুক।”

    হাওড়া স্টেশন থেকে সালকিয়া চৌরাস্তা পেরিয়ে বাবুডাঙ্গা মোড় এলেই ডান হাতে পড়বে শ্রীরাম ঢ্যাং রোড। হুগলির রাজহাটি নামক গ্রামের জমিদার শ্রীরাম ঢ্যাং মহাশয় ব্যবসা সূত্রে সালকিয়ায় আসেন। এখানে তিনি শুরু করলেন লোহা ঢালাই-এর কারখানা। পরে ১৪, ব্যানার্জি বাগান লেনের বসত বাড়িতে তিনি ঢ্যাং পরিবারের দুর্গাপুজো শুরু করেন ১৮৭৩ সালে। পরবর্তীকালে তিনি “শ্রী শ্রী দুর্গামাতা ও লক্ষীমাতা সহায়” নামে একটি এস্টেট চালু করেন। এখনও এই এস্টেট দ্বারাই পুজোর যাবতীয় কাজকর্ম ও খরচাপাতি পরিচালিত হয়।

    এই পরিবারের দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু হয় জন্মাষ্টমীর দিন থেকে। ওইদিন ভোরে বাড়ির ছেলেরা গঙ্গাস্নান করে তুলে আনেন গঙ্গামাটি। নতুন কাঁচা বাঁশ ও গঙ্গামাটি পুজো করে শুরু হয় প্রতিমা গড়ার কাজ। বাড়ির ঠাকুরদালানেই সাবেক কাঠামোতে গড়া হয় প্রতিমা। ডাকের সাজের সাবেক একচালা প্রতিমার আদলই বজায় রেখেছে পরিবার। জন্মাষ্টমী থেকেই পুজোর নানা নিয়ম ও আচার পালন শুরু হয়।

    মহাষষ্ঠীর সকালে হয় বেলবরণ। ঘট স্থাপন করে চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে দিয়ে হয় দেবীর বোধন। মহাসপ্তমীর ভোরে বাড়ির পুরুষরা ও পুরোহিতরা মিলে গঙ্গায় নবপত্রিকা (কলাবউ) স্নান করিয়ে আনেন। গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার নির্দিষ্ট মেনে যথাসময় নবপত্রিকা প্রবেশ হয় বাড়িতে। এরপর নবপত্রিকা তথা কলাবউকে কনের সাজে টুকটুকে লাল বেনারসি শাড়ি ও সোনার গয়না পরিয়ে গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়।

    এরপর মা দুর্গা ও গণেশের ঘট স্থাপন হয়। এবার মায়ের চক্ষুদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু হয়। এইসময় একটি ছাঁচি-কুমড়ো বলি দেওয়ার রীতি আছে। ঢ্যাং পরিবারের পুজোর এক বিশেষ নিয়ম আছে, সপ্তমীর সন্ধ্যায় বারোজন ব্রাহ্মণকে লুচি, ফল, মিষ্টি ও দক্ষিণা দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়।

    অষ্টমীর দিন, অষ্টমী পুজোর শেষে ও সন্ধিপুজোর সময় ‘ধূনো-পোড়ানো’ হয়। বাড়ির মেয়ে-বউরা সারিবদ্ধ হয়ে মায়ের সামনে বসে, তাদের দু’হাতে ও মাথায় একটি করে মাটির হাঁড়ি বসানো হয়। তাতে কর্পূর জ্বালিয়ে ধূনো পোড়ানো হয়। এরপর ছোট থেকে বড় সবাই এই মহিলাদের কোলে বসে ও মাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়। অষ্টমীর দিন আত্মীয়স্বজন ও লোক সমাগমে ভরপুর থাকে। নবমীর দিন পাঁচ রকমের ফল বলি দেওয়ার রীতি আছে। এদিন ‘কুমারী পুজো’ ও সবশেষে হোম হয়। সন্ধ্যা আরতির সময় বাড়ির ছোট থেকে বড় সবাই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ঠাকুর দালানে উপস্থিত থাকেন।

    পুজোর দিনগুলিতে রোজ সকালে ফল, মিষ্টি ও নারকেল নাড়ু দিয়ে মায়ের ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় লুচি, নানারকম মিষ্টি, ক্ষীর-রাবড়ি ইত্যাদি রোজ মায়ের ভোগ দেওয়া হয়। দশমীর দিন সকালে মায়ের পুজো শেষে ঘট নাড়িয়ে দিয়ে মায়ের নিরঞ্জন পর্ব শুরু হয়। এরপর হয় সিঁদুর খেলা। রাতে মাকে বরণ করে সালকিয়ার শ্রীরাম ঢ্যাং (ফুলতলা) ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। আপাতত পুজো প্রস্তুতিতে ব্যস্ত পরিবারের লোকজন। 
  • Link to this news (প্রতিদিন)