‘মানসিক যন্ত্রণা নিতে পারছি না’, বাবা-মাকে ‘খুন’ করে সুইসাইড নোট ঝাড়গ্রামের SI-এর
প্রতিদিন | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সুনীপা চক্রবর্তী, ঝাড়গ্রাম: অনেক মানুষের জীবনেই হয়ত এমন পরিস্থিতি আসে, যখন মনে হয়, ‘মরে গেলে হতো বেশি ভালো’। এসআই-এর সুইসাইড নোট যেন তেমন পরিস্থিতির কথাই বলছে। বাড়িতে অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা, মা। সেবা করতে করতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। একদিকে পুলিশের ডিউটির মতো কঠিন কাজ, অন্যদিকে মূক ও বধির বাবাকে সামলানো। একই সঙ্গে মায়ের দায়িত্বও ছিল তাঁর কাঁধে। প্রবল চাপে মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছিলেন জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়। আর এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতেই বাবা, মাকে শেষ করে দিলেন তিনি! ছুটির মধ্যেই বাবা-মাকে গুলি করে খুন করে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন এসআই। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনি এসএসকেএমে চিকিৎসাধীন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে উদ্ধার হওয়া সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, ‘বাবার অসুস্থতার জন্য আমার মানসিক অবস্থা ভালো নেই। এই মানসিক যন্ত্রণা নিতে পারছি না। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি মরে গেলেই কি ঠিক হবে? তাহলে মা ও বাবাকে কে দেখবে? তার থেকে তিনজনে মিলে মরে যাওয়া ভাল। মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’
জয়দীপের আদি বাড়ি আসানসোলের বামুনপাড়া এলাকায়। তিনি জঙ্গলমহল ব্যাটেলিয়নের ঝাড়গ্রামে সাব-ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত। ঝাড়গ্রাম শহরের রঘুনাথপুরের গৌড়ীয় মঠের কাছে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। বাড়িটির একতলাতে মা শম্পা চট্টোপাধ্যায় ও বাবা দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকতেন। জয়দীপ বিয়ে করেননি। বাবা, মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। তবে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, মানসিক অবসাদের জেরেই বাবা, মাকে খুন করে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ওই পুলিশ কর্মী।
পুলিশের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ২, ৩ এবং ৪ সেপ্টেম্বর ছুটি নিয়েছিলেন জয়দীপ। ছুটিতে থাকাকালীনই এদিন খুব ভোরে বাবা-মাকে লক্ষ্য করে জয়দীপ দুই রাউন্ড গুলি চালান৷ নিজের সার্ভিস পিস্তল ব্যবহার করেই জয়দীপ গুলি চালান বলে জানা যাচ্ছে। ঘটনাস্থলেই বাবা দেবব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং মা শম্পা চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। ঘটনার পরেই ওই সার্ভিস রিভলভার থেকেই নিজের থুতনির নিচে গুলি চালিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন জয়দীপ। পরপর গুলির শব্দ শুনেই ছুটে যান ওই বাড়ির মালিক এবং প্রতিবেশীরা। দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় দেহগুলি পড়ে রয়েছে। পুলিশ গিয়ে দেহগুলি উদ্ধার করে।
জয়দীপকে প্রথম উদ্ধার করে ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয়। পরিস্থিতি খুবই আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে এসএসকেএম স্থানান্তরিত করা হয়। জানা গিয়েছে, জয়দীপের গুলি আটকে রয়ে গিয়েছে মুখ এবং মাথাতেও। স্থানীয়দের দাবি, বাবা-মা খুব একটা রাস্তায় বের হতেন না। জয়দীপ সকালে বেরিয়ে গিয়ে রাতে ফিরতেন। বাড়িতে একাই থাকতেন বাবা-মা। এমনকী বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে জয়দীপ যেতেন বলেও দাবি স্থানীয়দের। ফলে কাজে থাকলেও সারাদিন দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হতো তাঁকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর দেড়েকের বেশি সময় ধরে ভাড়ায় রয়েছেন তাঁরা। খুব একটা পাড়ায় ঘনিষ্ঠতা ছিল না। প্রতিবেশীরা জানান, বেশিরভাগ সময় তাঁদের ঘরের দরজা বন্ধ থাকত। স্থানীয়দের দাবি, মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন জয়দীপ। কারও সঙ্গে তিনি বিশেষ কথা বলতেন না। যদিও সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরই এক সহকর্মী। একটি সূত্রের দাবি, গ্রাম থেকে বাবা, মাকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন। শুধুমাত্র ভালোভাবে রাখবেন, সেবা করবেন বলে। জানা গিয়েছে, তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী ছিলেন। তবে অবসরে পরেই তিনি কোনও অসুস্থতার কারণে কথা বলতে পারতেন না এবং কানেও শুনতে পেতেন না। কীভাবে সুস্থ করা যাবে বাবাকে? সেই চিন্তাতেই সম্ভবত এই ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে।
কয়েক বছর আগে গোপীবল্লভপুর থানার ছাতিনাশোলে এক কনস্টেবল নিজের বাড়িতে বাবা-মাকে গুলি করে খুন করে পরে আত্মহত্যা করেন। এবার নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করলেন এসআই জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়।