সুখেন্দু পাল, ভাতার: এ এক অন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’র গল্প। মূল চরিত্র কিন্তু কাল্পনিক নয়! তিনি আর পাঁচজনের মতো আটপৌরে বাঙালি বধূ সুস্মিতা রোম। জীবনের প্রতিপদে ‘দুর্গতি আর দুর্গতি’। কোলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন চার বছরের ছেলে। মারা গেলেন স্বামী। হারিয়ে ফেললেন ছেলের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার অর্থ-শক্তি। চলে এলেন বাপের বাড়ি। যাকে ভরসা করে এলেন, সেই বাবাও মারা গেলেন কয়েক মাসের মধ্যে। আতান্তরে পড়লেন সুস্মিতা। কী করবেন, ছেলেকে কী খাওয়াবেন, ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না। একদিন বাবার রেখে যাওয়া টোটোতে নজর আটকে যায় তাঁর। বাগ মানছিল না চোখের জল। আর সেদিনই সুস্মিতা খুঁজে পেয়েছিলেন ‘দুর্গতিনাশে’র উপায়। পরের দিন থেকে টোটোর হ্যান্ডল ধরে প্র্যাকটিস। তারপর রাস্তায়। কোলে ছেলে। এখন সুস্মিতা পুরোদস্তুর ভাতারের মহিলা টোটোচালক। দিন শেষের আয়ে সংসার যাপন, আর ছেলের চিকিৎসা। বাস্তবের সুস্মিতা এখন ভাতারের ‘দুর্গা’।
ভাতার গ্রামেই বাড়ি সুস্মিতার। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা। বাবা অটো চালিয়ে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। বেশিদূর পড়তে পারেননি। বিয়ে হয়ে যায়। নতুন সংসার। স্বামীর আয়ে মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। সংসারে এল নতুন অতিথি। কিন্তু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হয়ে! শুরু হল তাঁর নতুন লড়াই। ছেলের যখন চার বছর বয়স, তখনই মারা গেলেন স্বামী। টোটো চালাতে চালাতে সুস্মিতা বলছিলেন, ‘সন্তান তখন খুব অসুস্থ। চিকিৎসার প্রয়োজন। বাপেরবাড়ির অবস্থা ভালো নয় জেনেও চলে এসেছিলাম। বাবাও মারা গেল। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে মন চায়নি। তখনই বাবার রেখে যাওয়া টোটো চালানোর সিদ্ধান্ত নিই। অসুস্থ শিশুকে বাড়িতে রেখে যেতে পারিনি। তাই ওকে বুকে বেঁধেই টোটো চালাই। প্রথম দিকে অসুবিধা হতো। এখন হয় না।’ সুস্মিতার এই লড়াই সম্পর্কে অবগত পুলিস সুপার সায়ক দাস। বলছিলেন, ‘সুস্মিতাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা ওঁকে সম্মান জানিয়েছি।’ পূর্ব বর্ধমান জেলাপরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ তথা ভাতারের বাসিন্দা শান্তনু কোনারের কথায়, ‘সুস্মিতা মাতৃশক্তির অনন্য নজির। মায়েরা যে সব পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেন, সেটা উনি প্রমাণ করে দিয়েছেন।’
ভাতারের রস্তায় তখন সন্ধ্যা নামছে। বাড়ি ফেরার আগে সুস্মিতা হাঁক দিচ্ছেন—‘ভাতার বাজার কে যাবেন?’ দু’জন যাত্রী এসে টোটোয় উঠলেন। ছেলেকে বুকে আঁকড়ে টোটো চালাতে শুরু করলেন সুস্মিতা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রৌঢ় বললেন, ‘এ মেয়ের লড়াই সমাজের কাছে দৃষ্টান্ত। জীবন-যুদ্ধে শেষ হাসি হাসবেনই। সাক্ষাৎ যেন দুর্গা দুর্গতিনাশিনী।’
শরতের আকাশে এখন আগমনির সুর। ক’দিন পর মা আসবেন মণ্ডপে। সুস্মিতা তখন একটু বাড়তি রোজগারে ব্যস্ত থাকবেন। অষ্টমীর অঞ্জলি হয়তো তাঁর দেওয়া হবে না। কিন্তু, মায়ের কাছে নিশ্চয়ই প্রার্থনা করবেন—‘আমায় শক্তি দাও মা।’