• দলের নয়, মহুয়ার মতুয়া-মন্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত, অভিমত সাংসদ মমতাবালার, তবু সতীর্থকে না বলে নালিশ মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে
    আনন্দবাজার | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • এক তৃণমূল সাংসদের মন্তব্যের বিরোধিতা করে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি আর এক তৃণমূল সাংসদের অনুগামী সংগঠনের। যে ‘নালিশ’ দ্বিতীয় সাংসদের ‘অনুমোদিত’। প্রথমজন মহুয়া মৈত্র। দ্বিতীয়জন মমতাবালা ঠাকুর। প্রথমজন তৃণমূলের লোকসভার সাংসদ। দ্বিতীয়জন রাজ্যসভার। বিবাদের বিষয় মতুয়াদের নিয়ে প্রথমজনের প্রকাশ্য মন্তব্য।

    গত কয়েক দিন ধরেই মতুয়াদের সম্পর্কে কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়ার মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক চলছে। সে বিতর্কে মতুয়া ঠাকুরবাড়ির বিবদমান দুই অংশই এক সুরে মহুয়ার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল। এ বার তৃণমূলে মহুয়ার সতীর্থ সাংসদ মমতাবালার অনুগামীরা চিঠি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মহুয়ার মন্তব্য মতুয়া তথা নমঃশূদ্র সমাজের ‘আত্মসম্মানে আঘাত’ দিয়েছে বলে লেখা হয়েছে সে চিঠিতে।

    মমতাবালার অবশ্য দাবি, মহুয়ার মন্তব্য তাঁর ‘ব্যক্তিগত’। তা হলে কেন মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি? কেন সরাসরি মহুয়ার সঙ্গে তিনি কথা বলছেন না? মমতাবালার জবাব, ‘‘এমন মন্তব্য যিনি করতে পারেন, তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলার ইচ্ছা নেই।’’

    মুখ্যমন্ত্রীকে বৃহস্পতিবার যে চিঠি লেখা হয়েছে, তাতে ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ’-এর (মমতাবালার অনুগামী অংশ) সাধারণ সম্পাদক সুকেশচন্দ্র চৌধুরীর স্বাক্ষর রয়েছে। চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘কৃষ্ণনগর লোকসভার সাংসদ মহুয়া মৈত্র মতুয়া, নমঃশূদ্র, তফসিলিদের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়ে কটাক্ষ করে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। এমনকি, মতুয়াদের প্রাণপ্রিয় কণ্ঠহার ‘আচারমালা’কে বিদ্রূপ করে ‘কাঠের মালা’ বলে তাচ্ছিল্যভরে অবজ্ঞাসূচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। তাতে মতুয়াদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে। তাঁর এই অভিব্যক্তি সমগ্র মতুয়া, নমঃশূদ্র সমাজের আত্মসম্মানে আঘাত করেছে, যাতে সমগ্র মতুয়া-তফসিলি সমাজ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ।’’ চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আর্জি জানানো হয়েছে, ‘আপনি মতুয়াদের এই অসম্মানকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে এই ব্যথা নিরসনের জন্য অভিভাবকের ন্যায় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

    চিঠিটি যে তাঁর অনুমতি নিয়েই লেখা হয়েছে, সে কথা মমতাবালা অস্বীকার করেননি। চিঠির উপরে ‘সঙ্ঘাধিপতি’ হিসেবে মমতাবালার নামও রয়েছে। কিন্তু মহুয়ার মন্তব্যকে এত ‘গুরুতর’ হিসাবে যখন ধরা হচ্ছে, তখন মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি নিজে চিঠি লিখলেন না কেন? মমতাবালা বলছেন, ‘‘আমি সাংসদ হিসেবে কেন ধর্মীয় বিষয়ে নাক গলাতে যাব? আমার তো সংগঠন রয়েছে। ধর্মীয় বিষয় সংগঠনই দেখাশোনা করে। মহুয়া মৈত্রের মন্তব্য আপত্তিকর। তাই আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সংগঠনের তরফ থেকেই এর প্রতিকার চাওয়া হবে।’’

    বিতর্কের সূত্রপাত কৃষ্ণনগরের এক সভা থেকে। সম্প্রতি ওই সভায় মহুয়াকে বলতে শোনা যায়, “সারা বছর তৃণমূল৷ আর ভোটের সময় সনাতনী৷ এটা কী অঙ্ক ভাই?” সেই মঞ্চ থেকে মহুয়া মনে করিয়ে দেন, লক্ষ্মীর ভান্ডারে অন্যদের তুলনায় তফসিলি জাতি, জনজাতির মহিলারা বেশি টাকা পাওয়া সত্ত্বেও মতুয়াপ্রধান বিভিন্ন বুথে অন্য দলকে ভোট দেওয়া হয়। মহুয়ার কথায়, ওই বুথগুলিতে ১০০টি ভোটের মধ্যে ৮৫টি যায় বিজেপিতে এবং ১৫টি যায় অন্য দলে। এর পরে তৃণমূল সাংসদ আরও বলেন, “কাজের সময় মমতা, রাস্তার সময় মমতা৷ কাঠের মালা পরে সব তো চলে আসেন ভাই ভাতা নিতে! তখন কী হয়?”

    কৃষ্ণনগরের সাংসদের এই মন্তব্য ছড়িয়ে পড়তেই সরব হয় মতুয়া ঠাকুরবাড়ি। বনগাঁর বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর মহুয়ার সমালোচনা করেন। মমতাবালা সরাসরি মুখ না খুললেও অনুগামী সংগঠনকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ান। তাঁর অনুগামীরা তখনই জানিয়েছিলেন যে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানানো হবে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানানোর আগে মমতাবালা নিজে কেন মহুয়ার সঙ্গে কথা বললেন না, সে প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট নয়। মমতাবালার কথায়, ‘‘কোনও দল কখনও এ ভাবে কোনও একটা সমাজকে অপমান করার শিক্ষা কারওকে দেয় না। মহুয়া মৈত্র যা বলেছেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত মন্তব্য।’’ কিন্তু মন্তব্য যখন মহুয়ার ‘ব্যক্তিগত’ বলেই তিনি মনে করছেন, তখন মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি কেন? মমতাবালা সরাসরি মহুয়াকে ফোন করে বা মুখোমুখি প্রশ্ন করছেন না কেন? মমতাবালার উত্তর, ‘‘যিনি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন, তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলার ইচ্ছা নেই। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের অভিভাবক। তাই সংগঠন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রীকেই জানানো হবে।’’

    মহুয়া আগেও বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যে আলটপকা মন্তব্য দলকে ফ্যাসাদে ফেলেছেন। মা কালী বিষয়ে তাঁর একটি মন্তব্য থেকে টুইট করে দূরত্ব রচনা করেছিল তৃণমূল। এ বারের মন্তব্যটিও দলের অন্দরে খানিকটা শোরগোল তুলেছে। তবে মমতাবালার অনুগামীদের সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখায় তা ভিন্ন মাত্রা পেল। এখন দেখার, মুখ্যমন্ত্রী নিজে বা দলের কোনও শীর্ষনেতা এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করেন কি না।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)