অমলদা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন ফুটবল সাধক: সত্যজিৎ চ্যাটার্জি
বর্তমান | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
গুরু ছাড়া জ্ঞান লাভ হয় না। শিষ্যের কাছে তিনি শুধু শিক্ষকই নন, পথপদর্শকও বটে। শিষ্যের শক্তি-দুর্বলতা বিবেচনা করে আলোর পথ দেখান প্রকৃত গুরু। এই সম্পর্ক চিরন্তন। আজ শিক্ষক দিবসে বর্তমান পাঠকদের জন্য তিন ছাত্রের শ্রদ্ধাঞ্জলী। কোচ পিকে’কে নিয়ে কলম ধরলেন মজিদ বাসকর। ঠিক তেমনই সত্যজিৎ চ্যাটার্জি এবং প্রবীণ আমরের স্মৃতিচারণ জুড়ে শুধুই অমল দত্ত এবং রমাকান্ত আচরেকর।
উস্কোখুস্কো চুল। গায়ে অতি সাধারণ গেঞ্জি। এক বিকেলে প্রজেক্টর ঘাড়ে বালির পাড়ায় হাজির ভদ্রলোক। সস্তার ব্যাগ থেকে ভিডিও ক্যাসেট বের করে বিদেশি ফুটবল দেখাতে শুরু করলেন তিনি। শুধু খেলা দেখানোই নয়, প্রতিটা মুভমেন্ট সেদিন টেকনিক্যালি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অমল দত্ত। প্রথম দর্শনেই মন জিতে নেন তিনি। পরবর্তীতে ওঁকে নিয়ে মুগ্ধতা ক্রমশই বেড়েছে। অমল দত্ত কোচেদের কোচ। আপশোস, প্রাপ্য মর্যাদা কোনওদিনও পাননি তিনি। চোখ বুজে অন্তত পাঁচ বছর অমলদার হাতে জাতীয় দলের দায়িত্ব ছাড়া উচিত ছিল। তিনিই পারতেন মরুভূমিতে মরূদ্যান গড়তে। স্বপ্নের ফানুস ওড়াতে মানুষটার জুড়ি নেই।
অমল দত্ত মাঠের ধুলোমাখা সাধক। একাধারে আবিষ্কারক ও ফুটবল গবেষক। শুধু ট্রফি জয়েই থেমে থাকতে চাননি অমলদা। তাঁর কোচিংয়ের নান্দনিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ সমর্থকরা। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই তাঁর আকর্ষণ। আমার কাছে অমল দত্ত মানে মঞ্চের উৎপল দত্ত। প্রকৃত সাধকের মতো ভাঙতেন নিজেকে। রহিম সাহেবকে মাথায় রেখেও বলতে হয়, ভারতীয় ফুটবলে আধুনিকতার ছোঁয়া এসেছে অমলদার হাত ধরে। পেশাদার কোচ তিনি। এদেশে যাবতীয় ফর্মেশন ওঁরই আমদানি। একবার পিন্টুদাকে (সমরেশ চৌধুরি) লিবেরো পজিশনে খেলিয়ে চমকে দিয়েছিলেন। উইং ব্যাক ভবানী রায়কে ওভারল্যাপে পাঠানো অমলদার উপহার। ডায়মন্ড সিস্টেম, বক্স সিস্টেম ঝড় তোলে ময়দানে। ফুটবল নিয়ে অগাধ পড়াশুনা। ম্যাট বুসবি ও রিনাশ মিশেল তাঁর রোলম ডেল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও ডাচ কোচের টোটাল ফুটবলের স্বপ্ন দেখতেন তিনি।
অমলদাকে নিয়ে রাশি রাশি গল্প। শুনেছি, বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই পেশাদার কোচ হওয়ার টানে পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। পকেটে পয়সা নেই। বিয়ের গয়না বন্ধক রেখে টাকার জোগাড় হয়। অমলদার দূরদৃষ্টির তারিফ করতে হয়। ওই সাতের দশকেই অ্যাকাডেমির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। জমানো টাকায় বেলুড়ের চাঁদমারিতে জমিও কেনেন। কিন্তু লড়াই যে অসম। অ্যাকাডেমির স্বপ্ন হারিয়ে যায় প্রতিশ্রুতির ভিড়ে। তবু অমলদা থামেননি। শেষদিন পর্যন্ত ফুটবলের কথাই ভেবেছেন। অন্যদের চেয়ে কোথায় আলাদা অমলদা? তারকাপ্রথায় বিশ্বাসী নন কোনওদিন। বরং জুনিয়র ফুটবলারদের ভগবান। কাদামাটি ভেঙে কাঠামো গড়াই তাঁর পছন্দ। কিছুটা খ্যাপাটে, আত্মভোলা। সাধকরা এমনটাই হন। কবি অক্ষয় দত্তের আত্মীয়। মিঠে হাতে বোল তুলতেন তবলায়। পাশাপাশি ঠোঁটকাটা, বিতর্কিত। আসলে না পাওয়ার যন্ত্রণা কুরে কুরে খেত। মাঠের বাইরের রাজনীতি বোঝেননি কখনও। তার প্রয়োজনও নেই। মানুষের হৃদয়ে অমল দত্তের আসন চিরস্থায়ী। শ্রদ্ধার ফুল সাজানো ডালিতে।