আজকাল ওয়েবডেস্ক: কেরালাতে এবার মগজখেকো অ্যামিবার দাপট। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোঝিকোড়ের এক ছোট গ্রামে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনায় কেরালা এক নতুন স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। অন্নায়া, চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী, ক্লান্ত অবস্থায় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর হঠাৎ জ্বর ও বমিতে আক্রান্ত হয়। পরিবার ভেবেছিল সাধারণ কোনও সংক্রমণ। কিন্তু মাত্র একদিনের মধ্যেই, হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায়, সে মারা যায়।
পরীক্ষার ফল জানাল অন্নায়ার মৃত্যু হয়েছে অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিসে। মস্তিষ্কে আক্রমণকারী এক বিরল সংক্রমণে, যার জন্য দায়ী মুক্তভাবে বসবাসকারী অ্যামিবা, যা পুকুর, কুয়ো ও নদীর জলে জন্মায়। অন্নায়ার হঠাৎ মৃত্যু এবং পরবর্তী সময়ে কোঝিকোড়, মলাপ্পুরম ও ওয়ানাড় জেলায় একাধিক এমন ঘটনা প্রকাশ্যে আসায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানে একসময় প্রায় উপেক্ষিত এই অদৃশ্য ঘাতক আবার সামনে চলে আসে।
এই রোগের জন্য প্রধানত দায়ী নেগ্লেরিয়া ফাওলেরি , যাকে প্রায়ই বলা হয় ‘ব্রেন-ইটিং অ্যামিবা’ বা ‘মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা’। এটি গরম মিষ্টি জলে ভালোভাবে বেড়ে ওঠে এবং নাক দিয়ে শরীরে ঢুকে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। দ্রুত টিস্যু ধ্বংস করে। বিশ্বজুড়ে এই রোগকে বলা হয় প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস । প্রথম এটি শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে কয়েকজন শিশু দূষিত সুইমিং পুলে সাঁতার কাটার পর মারা যাওয়ার ঘটনায়।
পরে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে (বিশেষত ফ্লোরিডা, টেক্সাস ও অ্যারিজোনা), পাকিস্তানের করাচি, লাতিন আমেরিকা, চীন ও জাপানে এই রোগে একাধিক মৃত্যু ঘটে। করাচিতে দূষিত পৌরসভার জল, আর জাপানে স্থানীয় কিছু সাংস্কৃতিক অভ্যাসকেও কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে।
ভারতে এতদিন এই ধরনের ঘটনা ছিল ছড়ানো-ছিটানো। কেরালায় প্রথম মৃত্যু রেকর্ড হয় ২০১৬ সালে আলাপ্পুঝায়। জনস্বাস্থ্য সূচকে দীর্ঘদিন শীর্ষে থাকা কেরালা যেখানে শিশুমৃত্যুর হার কম, আয়ু বেশি, আর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নেটওয়ার্ক আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত এখন এক নজিরবিহীন সমস্যার সামনে।
২০২৪ সালে কেরালায় ২৯টি নিশ্চিত সংক্রমণ ধরা পড়ে, মূলত দক্ষিণাঞ্চল থেকে। তবে যেখানে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুহার ৯৭% এর বেশি, সেখানে কেরালা ২৪ জন রোগীকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল, আক্রমণাত্মক চিকিৎসা প্রোটোকল এবং বিদেশ থেকে আনা অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ওষুধ মিল্টেফোসিন ব্যবহারের মাধ্যমে।
চিকিৎসক ও মহামারীবিদরা এই বৃদ্ধি ব্যাখ্যা করছেন একাধিক কারণে। জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বাড়া, কুয়ো ও পুকুরে নোংরা বর্জ্য ও জৈব দূষণ জমা হওয়া, এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক কিছু অভ্যাস যা শিশুদের অপরিশোধিত জলের সংস্পর্শে নিয়ে আসে। মলাপ্পুরমে এক কিশোর সাঁতার কাটার পর কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যায়, এরপর গ্রামবাসীরা পুকুর ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। তিরুবনন্তপুরমের আথিয়ান্নূরে দেখা যায়, শুধু স্নান নয়, তামাক গুঁড়োর সঙ্গে জল নাকে টানার স্থানীয় প্রথাই অ্যামিবাকে সরাসরি মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়।
কেরালার স্বাস্থ্যব্যবস্থা হিমশিম খেলেও দ্রুত অভিযোজিত হয়েছে। আগে রোগ নিশ্চিত করতে নমুনা পাঠাতে হতো চণ্ডীগড়ে, এখন তিরুবনন্তপুরমেই পরীক্ষা হয়। চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মেনিনজাইটিস রোগীদের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক জলের সংস্পর্শ ছিল কি না, সে প্রশ্ন করতেই হবে, এবং সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।