• অতটাও 'হ্যাপি টিচার্স ডে' নয়, ভারতে প্রায় ৪২% শিক্ষকতাই চুক্তি বিহীন ...
    আজকাল | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্রতিদিন ভোরে শাড়ি পরে শিবানী নামের এক শিক্ষিকা ভিড়ভাট্টা বাসে চেপে যান বিহারের গ্রামীণ এক বেসরকারি স্কুলে। শ্রেণিকক্ষে তিনি "ম্যাডাম" — সম্মানিত, প্রিয়, ছাত্রছাত্রীদের একসঙ্গে উচ্চারিত "গুড মর্নিং"। কিন্তু স্কুলের চার দেয়ালের বাইরে বেরোলেই তিনি আর পাঁচজনের মতোই জীবিকা-সংগ্রামী এক  নারী। প্রায় এক দশক ধরে পড়ানো সত্ত্বেও শিবানীর মাসিক আয় মাত্র ৮,০০০ টাকা। যা তার জেলার অনেক ড্রাইভার বা ডেলিভারি কর্মীর চেয়েও কম। চাকরির কোনো স্থায়ী চুক্তি নেই, নেই পেনশন বা চিকিৎসা সুবিধা। শিবানীর কথায় — “যদি আমি অসুস্থ হই বা চাকরি হারাই, আমার ভরসা করার মতো কিছুই থাকবে না।”

    শিবানীর মতো গল্প দেশজুড়ে অসংখ্য। ইউনেস্কোর স্টেট অব এডুকেশন রিপোর্ট (ভারত) বলছে, দেশের ৪২ শতাংশ শিক্ষকই চুক্তিবিহীন। বেসরকারি স্কুলগুলিতে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ: ৬৯ শতাংশ শিক্ষক কোনো লিখিত চুক্তি ছাড়াই কাজ করেন এবং তাদের বেশিরভাগের বেতন ১০,০০০ টাকার নিচে। বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলের বেসরকারি স্কুলে নারী শিক্ষকদের গড় বেতন ৮,২১২ টাকা — যা জাতীয় গড়ের প্রায় ৪০ শতাংশ কম। এমনকি ওড়িশার হাজার হাজার চুক্তিভিত্তিক জুনিয়র শিক্ষক বর্তমানে চাকরির স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলন করছেন। ছয় বছরের চুক্তি পরিষেবার পরও তারা কোনো সামাজিক নিরাপত্তা বা ভবিষ্যৎ সুবিধা পান না।

    মহিলা শিক্ষকদের বিশেষ বিপন্নতা- ভারতে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকতায় নারীদের আধিপত্য থাকলেও তারাই সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার।  অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী শিক্ষিকাদের প্রকৃত বেতনের বদলে সাম্মানিক দেওয়া হয়, যা শ্রম আইনের আওতার বাইরে রাখে। তাদের বলা হয় শিক্ষকতা নাকি ‘নতুন পেশা’, তাই বেশি বেতনের দাবি করা উচিত নয়। সংসারের 'অবৈতনিক' কাজ সামলানোর পাশাপাশি অল্প বেতনে স্কুলের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাস নিতে হয়। 

    গুরগাঁওয়ের কিছু শিক্ষিকা জানিয়েছেন, কোভিড মহামারির সময় তাদের বেতন ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত কেটে দেওয়া হয়েছিল। বাধ্য হয়ে অনেককে স্বামীর আয়ের উপর নির্ভর করতে হয়েছে, অথবা রাত জেগে বাড়িতে টিউশন নিতে হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের এক শিক্ষিকার বক্তব্য আরও তীব্র: “সকালে আমি বাচ্চাদের অ আ ক খ শেখাই, আর সন্ধ্যায় পাড়ার মানুষের কাপড় সেলাই করি। আমার ছাত্রছাত্রীরা ভাবে আমি সম্মানিত, কিন্তু তারা জানে না আমি আইসক্রিম বিক্রেতার চেয়েও কম রোজগার করি।”

    শিক্ষক দিবসে ছাত্রছাত্রীরা ফুল-কার্ড নিয়ে শুভেচ্ছা জানালেও সুনিতা নামের এক শিক্ষিকার মনে তখনও ভর করে থাকে বাস ভাড়ার টাকা, রেশন বিল, কিংবা নিজের সন্তানের স্কুল ফি’র চিন্তা। যে পেশাকে একসময় নিরাপদ ও মর্যাদার প্রতীক মনে করা হত, সেটিই আজ ফাঁদে পরিণত হয়েছে — স্থিতিশীলতার নাম করে অনিশ্চয়তার শৃঙ্খল।

    বেসরকারি স্কুলগুলোতে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা ফি ওঠে, অথচ শিক্ষক বেতনের জন্য ব্যয় হয় মাত্র ২ শতাংশের মতো। দেশে যখন ‘নলেজ ইকোনমি’র জয়গান গাওয়া হচ্ছে, তখন সেই জ্ঞানের মূল কারিগররা — মহিলা শিক্ষকরা — অদৃশ্য, মূল্যহীন  ও শোষিত। ওড়িশা ও মিজোরামে সম্প্রতি শিক্ষকেরা শিক্ষক দিবস বয়কট করে বকেয়া বেতনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু শিবানীর মতো অধিকাংশ নারী শিক্ষিকার পক্ষে আন্দোলনে নামা সম্ভব নয়। চাকরি হারালে সংসার ভেঙে পড়বে।

    কেন এই শিক্ষক দিবস গুরুত্বপূর্ণ? এই দিনে শুধু আবেগ নয়, প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ। ফুলের তোড়া বা হাতে লেখা কার্ড যতই মূল্যবান হোক, তা দিয়ে বাসভাড়া দেওয়া যায় না, সন্তানকে পড়ানো যায় না।

    শিক্ষকদের জন্য এখন দরকার:

    সব শিক্ষককে বাধ্যতামূলক লিখিত চুক্তি প্রদান।

    সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম বেতনের সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড।

    সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা, বিশেষত মহিলা  শিক্ষকদের জন্য।

    শিক্ষক দিবসে দেশকে মনে রাখতে হবে — শিক্ষকদের আমরা শুধু শুভেচ্ছা বা ফুল না। তাদের দিতে হবে মর্যাদা, নিরাপত্তা, আর ন্যায্য বেতন।
  • Link to this news (আজকাল)