সুখেন্দু পাল, বর্ধমান: সেই রাজাও নেই। সেই রাজত্বও নেই। এখন শুধু রাজ-অস্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। তাতেও যেন কেমন গা ছাড়া ভাব! ইতিহাস সুরক্ষায় চরম গাফিলতি। এই সেদিন বর্ধমানের রাজ প্রাসাদের নাটমন্দিরই ভেঙে পড়ল সবার চোখের সামনে! দেখে হা-হুতাশ করলেন শহরবাসী। দায় নিয়ে চলছে কাঁটাছেঁড়া। বিস্তর চর্চাও হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—‘রাজা নেই বলে কি রাজ-ঐতিহ্যও থাকবে না?’
আর ক’দিন বাদেই পুজো। একদা বর্ধমান রাজবাড়ির পুজো মানে গোটা বাংলার উৎসব। জৌলুসে ভরপুর। রাজদরবারে একাধিক এলাকার জমিদারের ভিড়। তাঁদের পেয়াদাদের আনাগোনা। প্রজাদের পাত পেড়ে খাওয়া। সে সব আজ বিস্মৃতির অতলে, ইতিহাসের পাতায়। তবু কোথাও যেন খানিক আবেগ আজও বেঁচে। নাটমন্দির ভেঙে পড়ার আক্ষেপ নিয়েও সেই আবেগ-অনুভূতিতে শান দিতে তৈরি বর্ধমানবাসী। আসলে রাজবাড়ির পটের দশভুজার মহিমা সম্পূর্ণ অন্যরকম।
নীলপুর থেকে গোলাপবাগ। পুজোর থিমে, আবেশে ভাসে গোটা শহর। জনস্রোত নামে রাজপথের অলিতে-গলিতে। তবুও যেন রাজবাড়ির পটেশ্বরীকে একবার চোখের দেখা না দেখলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় পুজো পরিক্রমা। পুজোর চারদিনের মধ্যে অন্তত একটি দিন পটেশ্বরীর পাদস্পর্শ পাওয়া চাই-ই চাই। সাবেকিয়ানার প্রতি এ এক অদ্ভুত টান। তার উপর রাজবাড়ির ‘কন্যা’ উমা বলে কথা। রূপ ঐতিহ্যে তিনি অনন্যা। তাঁর বাহন ঘোড়া। অসুরের মাথায় পাগড়ি। লক্ষ্মী, সরস্বতীর মুখাবয়ব পটচিত্রে।
ইতিহাসের উঠোন খোঁড়েন যাঁরা তাঁদের মতে, বর্ধমান রাজ পরিবারের এই পটেশ্বরী কয়েকশো বছরের প্রাচীন। একসময় রাজা মহাতাব চাঁদের ইচ্ছে হয়েছিল, দুর্গাপুজো করার। ডাক পড়ল কুলপুরোহিতের। তিনি পুঁথি ঘেঁটে বিধান দিলেন, আপনার বাড়িতে নারায়ণ শিলা রয়েছে। তাই মূর্তি পুজো করা ঠিক হবে না। আপনি বরং পটে আঁকা মায়ের মূর্তি পুজোর আজ্ঞা দিন। সেই থেকে রাজবাড়ির ভিতরে দুর্গাদালান তৈরি হল। পুজো শুরু হল। অন্য স্বাদের পুজো দেখার সুযোগ পেলেন বর্ধমানবাসী। মহাতাবের ‘সামন্ততন্ত্র’ থেকে আজকের ‘গণতন্ত্র’ পেরিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর কেটে গিয়েছে। রাজ-অহঙ্কার, জৌলুস হারালেও পটেশ্বরী কিন্তু এখনও অমলিন। পুজোও নিরবচ্ছিন্ন। বদলেছে শুধু স্থান। আগে পটেশ্বরী পুজো পেতেন দুর্গাদালানে। এখন লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে পুজো হয়। রাজবাড়ির নিয়ম মেনে প্রতিপদে ঘটোত্তলন। ন’দিন ধরে ডাণ্ডিয়া নৃত্য। পটেশ্বরীর বিসর্জন হয় না। ১২ বছর অন্তর অঙ্গরাগ হয়। নাটমন্দিরে হয় ডান্ডিয়া আয়োজন। এবার তা কোথায় হবে কে জানে। নাটমন্দিরটি ভেঙে পড়েছে ক’দিন আগে। শহরবাসীর আক্ষেপ ও আশা—সংস্কার হলে ভাঙত না। নিশ্চয় বিকল্প একটা ব্যবস্থা হবে। বর্ধমান দক্ষিণের বিধায়ক খোকন দাস বলেন, ‘আমরা শহরের সব প্রাচীন মন্দির সংস্কারে আগ্রহী। কিন্তু সেগুলি রাজপরিবারের বর্তমান সদস্যরা দেখভাল করেন।’ মন্দিরের পুরোহিত উত্তম মিশ্রের আক্ষেপ—‘পুরো মন্দিরটি জরাজীর্ণ। সংস্কার হওয়া জরুরি।’-নিজস্ব চিত্র