• কলকাতার কড়চা: বৃত্তি থেকে ব্রতে উত্তরণ
    আনন্দবাজার | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আকাশ থেকে দ্রুত নেমে আসা’, এর ইংরেজি অনুবাদ করাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। ছাত্রদের প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করেই খুব উৎসাহ দিয়ে বলছেন, “বল্, বল্, তোর হচ্ছে।” কারও উত্তরই মনমতো হচ্ছে না। শেষে নিজেই উত্তরটা দিয়ে হেসে বললেন, “দ্যাখ্‌ দেখি তোরা তো কেউ পারলি না, আমি কেমন পেরে গেলুম!” সঙ্গে সঙ্গে এক ছাত্র বলে উঠল, “আপনার হাতে তো বই আছে।” হাসির রোল উঠল, তাতে যোগ দিলেন শিক্ষকও।

    শিক্ষাকে আনন্দময় করে তুলতে শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের এমন বহু চেষ্টার সাক্ষী শান্তিনিকেতনে একেবারে প্রথম দিকের পড়ুয়ারা। সন্ধ্যায় ছাত্র ও অধ্যাপকদের নিয়ে পুস্তক পাঠ, গল্প বলা যেমন হত, তেমনই নানা রকম খেলাও। স্তূপ করে রাখা কড়ি থেকে ছাত্ররা কড়ির সংখ্যা আন্দাজ করত, অথবা পাত্রে রাখা আট-দশ রকম জিনিস এক নজরে দেখেই সেগুলির তালিকা করত।

    ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে পড়াতে হত বিদ্যাসুন্দর। খেউড় অংশ পড়ানোর সময় মাস্টারমশাইয়ের কু্ণ্ঠিত ভাব দেখে ইংরেজ সিভিলিয়ান ছাত্ররা পোপ ও শেক্সপিয়রের উদাহরণ দিয়ে তাঁকে উৎসাহ দিতেন মন খুলে পড়াতে। এই শিক্ষকই আবার পরীক্ষার সময় অতি কঠোর, উপরমহল থেকে কাউকে অন্যায় উপায়ে পাশ করিয়ে দেওয়ার অনুরোধের মুখে লড়েছেন, চাকরি বাজি রেখেও।

    এমএ পাশ করার পরেই মেয়েদের ইস্কুলে শিক্ষক করে শিবনাথ শাস্ত্রীকে নিয়ে এলেন কেশবচন্দ্র সেন। রোজ দুপুরে স্কুল বসত, সেখানে ইংরেজি শিখতেন স্বয়ং কেশবচন্দ্রের স্ত্রী। এক দিন জগন্মোহিনী দেবী পড়া করে আসেননি ক্লাসে, শিক্ষক ছাত্রীকে বললেন দুপুরের অবসরে কঠিন বিষয়গুলি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে দেখে নিতে। সেই মতো কেশবচন্দ্রের কাছে পড়া বুঝতে গেলেন তিনি। কিন্তু ফল জানা গেল পরের দিন। কেশবচন্দ্রই শিবনাথকে জানালেন যে তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলেছেন, “যাও যাও, তুমি শিবনাথবাবুর মতো পড়াতে পারো না।”

    নানা আশ্চর্য সম্পর্কের গোড়ার সূত্রও ধরিয়ে দেন শিক্ষকেরা। জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ় ইনস্টিটিউশনের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড উইলিয়াম হেস্টি এক বার ক্লাসে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর ‘এক্সকারশন’ কবিতা পড়াচ্ছিলেন, প্রসঙ্গত বললেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভবে কবির ‘ভাবসমাধি’প্রতিম অবস্থার কথা। ছাত্ররা ‘সমাধি’ কী তা বুঝতে না পারায়, তিনি তা যথাসম্ভব ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে তিনি সেই অবস্থায় দেখেছেন, ছাত্ররাও তাঁকে সেই অবস্থায় এক দিন দেখলে বিষয়টি বুঝতে পারবে। সেই ক্লাসের অন্যতম ছাত্র নরেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে এই প্রথম বার কেউ শ্রীরামকৃষ্ণের কথা বললেন। সাহেব শিক্ষকের এই ‘এগিয়ে দেওয়া’র কথা পরবর্তী কালে স্বীকারও করতেন স্বামী বিবেকানন্দ।

    বৃত্তির সীমানা ছাড়িয়ে শিক্ষকতাকে ব্রতের স্থান দেওয়া শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় গতকাল পালিত হল শিক্ষক দিবস। কিন্তু সত্য? সে যে সুকঠিন! শিক্ষক, শিক্ষকতা শব্দগুলির সঙ্গে একই বন্ধনীতে ‘দাগি’ বা ‘অযোগ্য’ শব্দের মুহুর্মুহু উচ্চারণ, এ-ও কি দেখার ছিল— আবহমান কাল ধরে বিদ্যাচর্চার অনুরাগী বঙ্গে?

    নতুন আলো

    ১২৮০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যার বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বেরিয়েছিল একটি প্রবন্ধ, সুন্দরবনের দক্ষিণের সমুদ্রখাত নিয়ে, শিরোনাম ‘অতলস্পর্শ’। বাংলা ভাষায় এই সমুদ্রখাতটি নিয়ে প্রকাশিত প্রথম প্রবন্ধ— লেখকনামহীন— এটি কি বঙ্কিমচন্দ্রের (ছবি) রচনা? এমনই প্রশ্ন উঠে এল সম্প্রতি, বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মভিটা নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্রে, শুধু সুন্দরবন চর্চা পত্রিকার (সম্পা: জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ি) ‘সুন্দরবন ও বঙ্কিমচন্দ্র’ বিশেষ সংখ্যা ঘিরে অনুষ্ঠানে৷ সুন্দরবনে বাঘ-মানুষ সংঘাত বিষয়ে প্রথম বাংলা প্রবন্ধও বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা কি না, উঠল সে কথাও। এক দশকেরও বেশি সময় সুন্দরবনের নানা অঞ্চলে কর্মরত ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, সেই সময়ের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এই সংখ্যাটিতে৷ খুলনা, যশোরের স্থানীয় লেখকেরা জানিয়েছেন বঙ্কিমের স্মৃতিজড়িত স্থানগুলির বর্তমান পরিস্থিতির কথা। ছবি প্রচ্ছদ থেকে, বিশ্বনাথ দাশগুপ্তের অঙ্কনে বঙ্কিমচন্দ্র।

    সমারোহ

    বাঙালির হাজার বছরের খাওয়া-পরার অভ্যাসই হোক বা বাংলা থিয়েটারের আদিপর্বের মেয়েদের কথা; কলকাতার অগ্নিযুগের স্মৃতিবিজড়িত ঘরবাড়ি, বা হিমালয় ভ্রমণের বৃত্তান্ত। নানা বিষয়ে কথালাপ, ২১১ বিধান সরণি ঠিকানায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ঐতিহ্যমণ্ডিত লাইব্রেরি হল-এ। উপলক্ষ: হস্তশিল্প ও পর্যটন মেলা, যেখানে থাকবে সোনাঝুরির কাঠের কাজ, পিংলার পটচিত্র থেকে শুরু করে ডোকরা, টেরাকোটা, দুই বাংলার বস্ত্রশিল্পের সম্ভার। মেলা এ বার এগারো বছরে, চলবে আগামী ১২ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর। আলোচনার আসর বসবে তার প্রথম তিন দিনে।

    জন্মদিন ঘিরে

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দুই কবি-বন্ধুকে নিয়ে প্রদর্শনী ভাবতে পারে কলকাতাই শুধু। সৌমিত্র মিত্র দু’জনকে কাছ থেকে দেখেছেন দীর্ঘ কাল, ওঁদের শরীরগতিক-মনমেজাজ থেকে কবিতাযাপন বা তরুণদের পৃষ্ঠপোষণা, সব কিছুরই সাক্ষী তিনি। সেই ‘দেখা’ই এ বার প্রদর্শনীর উপজীব্য, ‘আবৃত্তিলোক’-এর আয়োজনে, ‘দ্য বেঙ্গল’ ও সাহিত্য অকাদেমি-র সহযোগিতায় গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শশালায়, ৯-১১ সেপ্টেম্বর, রোজ দুপুর ২টো-রাত ৮টা। পরিকল্পনা ও নির্মাণ সৌমিত্র মিত্রের, উদ্বোধন করবেন জয় গোস্বামী। পরের দু’দিন সন্ধেয় প্রদর্শশালাকক্ষে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি, গান ও কথালাপ, ১১ তারিখে থাকবেন যোগেন চৌধুরী। মঙ্গলবার সন্ধে ৬টায় বাংলা আকাদেমি সভাকক্ষে বিশিষ্টজনদের আলোচনা ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’; আবৃত্তিলোক ও ব্রততী পরম্পরা-র সমবেত আবৃত্তি। এই সবই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন উপলক্ষে, আগামীকাল যাঁর ৯২তম জন্মদিন!

    পঞ্চাশের পথে

    “নান্দীকার-এর পিরানদেলো দেখে নিয়ে এসেছিলাম অজিতেশকে, হাটে-বাজারে-তে।” অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে তপন সিংহ; তাঁর আজীবন চলচ্চিত্র গ্রন্থের সম্পাদক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “এক-একটা বিদেশি ক্লাসিকের বাংলা থিয়েটারি রূপান্তর দেখি আর মনে পড়ে, কী মাটির স্বাদে, কী দেশজ স্বরে অজিতেশ এক-একটা নাটকের দেশায়ন ঘটিয়ে ফেলতেন, খুঁজে চলতেন বাংলা থিয়েটারের এক আধুনিক বিশ্বজনীন ভাষা।” নান্দীকার ছেড়ে অজিতেশ প্রতিষ্ঠা করেন ‘নান্দীমুখ’। নাট্যদলটির ৪৯ বছরের উদ্‌যাপন ৯ সেপ্টেম্বর অ্যাকাডেমি মঞ্চে সন্ধ্যা ৬টায়, জানালেন অশোক চট্টোপাধ্যায়, তিনিই এখন দায়িত্বে। প্রবীর ব্রহ্মচারীর আবৃত্তি, পবিত্র সরকারের কথা, পরে অসিত বসুর নির্দেশনায় তীর্থঙ্কর চন্দের নাটকের অভিনয়— জাসটিস।

    শহরে ইউরোপ

    ৮ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর, আইসিসিআর-এর সত্যজিৎ রায় প্রেক্ষাগৃহে উঠে আসবে ইউরোপ। ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস আর এনইজ়েড ফাউন্ডেশন মিলে আয়োজন করেছে সাম্প্রতিক কালের একগুচ্ছ ইউরোপীয় ছবি নিয়ে একটি চলচ্চিত্র অধিবেশন, থাকছে স্পেন ফ্রান্স রোমানিয়া নেদারল্যান্ডস গ্রিস অস্ট্রিয়া-সহ নানা দেশের সিনেমা। বড় পর্দায় কসোভো, নর্থ ম্যাসিডোনিয়া বা লাটভিয়ার সিনেমা দেখতে পাওয়া, সুযোগ বটে। প্রথম দিন দুপুর আড়াইটেয় শুরু, বাকি দু’দিন দুপুর ৩টে থেকে। সব ছবিই গত কয়েক বছরের মধ্যে তৈরি, হাতে-গরম! সোমবার সন্ধে ৬.১৫-য় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন, থাকবেন সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ গুণিজন।

    চোখ জুড়ানো

    বিভূতিভূষণের জীবন ও ভাবনার এক অনন্য উদ্‌যাপন এই মুহূর্তে শহরে। যোধপুর পার্কের ‘অরণ্যবাড়ি’তে চলছে প্রদর্শনী ‘আরণ্যক’, ২৯ অগস্ট-১২ সেপ্টেম্বর। তার ইতিহাসটা চমৎকার। বিভূতিভূষণের পৈতৃক বাড়িটি লেখকের পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর প্রায় বন্ধই ছিল, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র তৃণাঙ্কুর অতিমারির পর তার পরিচর্যার উদ্যোগ করেন। বহু মানুষ তা দেখতে আসতেন, ইচ্ছে জানাতেন কোনও স্মারক সংগ্রহেরও। গত দু’দশক দিল্লিবাসী শিল্পী তৃণাঙ্কুরকে সেই ভাবনাই প্রাণিত করে নিজস্ব নকশায় এমন কিছু পণ্য তৈরিতে, যারা একাধারে লেখকের সৃষ্টিবিশ্বের স্মারক। দেখা যাবে পথের পাঁচালী-র কালজয়ী চরিত্র-আধারিত মাত্রোশকা পুতুল (নীচে বাঁ দিকে), নোটবুক, ফ্রিজ ম‍্যাগনেট; বিভূতিভূষণের প্রিয় ফুল ঘেঁটু, কালকাসুন্দের মোটিফ-আঁকা ট্রে, কোস্টার, কুরুশের ঢাকা, পিতল ও ইলেকট্রো-প্লেটেড ফোটো ফ্রেম (ডানে); চাঁদের পাহাড়-এর সিলিকন লাগেজ ট্যাগ। চোখের শান্তি, মনেরও।

    স্মরণে

    নজরুলের লেখা গান ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’-র সুর করেছিলেন জগন্ময় মিত্র (ছবি), সেই তথ্য ও সত্য চাপা পড়ে যায় এ গান ঘিরে জনপ্রিয়তার আবহে। জগন্ময় মিত্র নিজে বাংলা সঙ্গীতজগতের এক নক্ষত্র, অজস্র গান গেয়েছেন, হিন্দিতে গান রেকর্ড করেছেন জগমোহন নামে। এই সেপ্টেম্বরই তাঁর জন্মমাস, আজই তাঁর জন্মদিন। প্রয়াণদিনটিও ছিল গত পরশু। গুণী শিল্পীর স্মরণে বাঘাযতীন যোগপ্রভা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বিশিষ্টজন-উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠান হল সে দিন, যাদবপুরে ইন্দুমতী সভাগৃহে। রা পত্রিকার জগন্ময় মিত্র বিশেষ সংখ্যারও আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হল— ছোট্ট পত্রিকা, কিন্তু শিল্পীকে ঘিরে মননশীল ও স্মৃতিমেদুর কয়েকটি লেখায় ঋদ্ধ। জগন্ময়ের কলমে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গ-স্মৃতিচারণ পড়া যাবে সেখানে; তাঁর রেকর্ড-ধৃত গানের একটি তালিকাও প্রকাশিত হয়েছে।

    যুদ্ধ ও কবিতা

    ইউক্রেন যুদ্ধের আগে বাঙালি মানসে সে দেশ নিয়ে ধারণা সে ভাবে ছিল কি? রুশ সাহিত্য আমাদের পড়া, কিন্তু ইউক্রেনের সাহিত্য? ২০২২-এ শুরু হওয়া যুদ্ধ এখনও থামেনি, এই প্রায় চার বছর ধরেই কলকাতায় ছিলেন ইউক্রেনের কবি ইরিনা ভিকিরচাক, স্বামীর কর্মসূত্রে এ শহরে ঘর বেঁধে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ছোট্ট এক দেশের কবি তিনি, ইউক্রেন ছেড়ে গিয়েছেন পোল্যান্ড ফ্রান্স জার্মানিতে, পরে এসেছেন ভারতে, তাঁর কবিতার বই বেরিয়েছে আমেরিকায়। তাঁর কবিতায় ঘনায় চেরনোবিলের কালো মেঘ, সোভিয়েট-রাজ অবসানে ইউক্রেনের জীবন ও মনের ঝলক। গত ২৭ অগস্ট দক্ষিণ কলকাতার ‘দ্য রেড বাড়ি’তে এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হল দেব চৌধুরীর বাংলা অনুবাদে ইরিনার কবিতাবই, দুঃখ মাপার যন্ত্র (প্রকা: সম্পর্ক)। ইউক্রেনীয়, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় কবিতাপাঠ হল, প্রাসঙ্গিক আলোচনাও— যুদ্ধক্লান্ত এক পৃথিবীতে কবিতা-কথা।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)