• বিদ্যাসাগরের জেলায় স্কুলে সবেধন শিক্ষক
    আনন্দবাজার | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • পাঁচটি শ্রেণি, তবে শিক্ষক এক জনই!

    — কী ভাবে চালান?

    — ‘‘একটা ঘরে সব ক্লাসকে বসিয়ে।’’

    — অসুবিধা হয় না?

    — ‘‘হলেও, উপায় কী!’’

    এটুকু বলে শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে সব শ্রেণির জন্য মিলিয়ে মিশিয়ে কিছু অঙ্ক লিখলেন। পড়ুয়াদের বললেন, ‘‘তাড়াতাড়ি কষেখাতা দেখা।’’

    ১০ মাস ধরে এ ভাবেই চলছে আগুইবনি ১ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা ১ ব্লকের শ্যামনগর অঞ্চলের এই বিদ্যালয়ে গত নভেম্বরে প্রধান শিক্ষক অবসর নিয়েছেন। সেই থেকে শিক্ষক অয়ন বক্সী স্কুলের ভরসা। অয়ন বললেন, ‘‘শিশু শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ৪৭ জন ছাত্রছাত্রী। শ্রেণি ভাগ করলে, একা পড়াব কী করে! তাই বড় হলঘরে সবাইকে বসিয়ে পড়াই।’’

    বাঁকুড়ার সীমানা লাগোয়া আগুইবনি গ্রামে বেশিরভাগ পরিবার কৃষিজীবী। সাধারণ ও তফসিলি জাতির পরিবারই বেশি। জনজাতিও রয়েছে। তবে খেটে-খাওয়া সেই সব পরিবারে তেমন স্কুলছুট নেই। এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তপনকুমার মল্লিক বললেন, ‘‘এখানে প্রত্যেকে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠান। পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকাটাই সমস্যা।’’ ১৯৫৫ সালে তৈরি এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০০৪ সালে সর্বশিক্ষা অভিযানের অর্থে নতুন ভবন হয়েছে। তাতে নীল-সাদা রঙের প্রলেপও পড়েছে। তবে শিক্ষক জোটেনি। এক অভিভাবকের কথায়, ‘‘মাস্টারমশাই সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে ক্লাস চালাচ্ছেন। কিন্তু এ ভাবে কিপড়া হয়!’’

    পড়া যে ঠিক মতো হচ্ছে না, বিদ্যালয়ের তরফে শিক্ষা দফতরে একাধিক বার সে কথা জানানো হয়েছে। শুধু পড়ানো নয়, মিড-ডে মিলের তথ্য রাখা, প্রশাসনিক কাজে বিভিন্ন দফতরে ছোটা, ছাত্রছাত্রীদের বই, পোশাক, জুতোও আনতে হয় অয়নকেই। কোনও কারণে তিনি ছুটি নিলে অন্য স্কুল থেকে শিক্ষক পাঠিয়ে কোনও মতে চালানো হয়। অয়নের আক্ষেপ, “পর্যাপ্ত ঘর আছে। অথচ, শিক্ষক না থাকায় সেগুলি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। শিক্ষক দিবস-সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানও করা যায় না।”

    ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিজের জেলায় এমন বহু এক শিক্ষকের প্রাথমিক বিদ্যালয় কার্যত ধুঁকছে। সম্প্রতি স্কুল শিক্ষা দফতরের নির্দেশিকায় রাজ্যের শিক্ষকশূন্য বা একমাত্র শিক্ষকের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাতে পশ্চিম মেদিনীপুর তিন নম্বরে। এখানে এমন প্রাথমিক স্কুল ২২৭টি। অথচ, প্রাথমিকে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত থাকার কথা ৩০:১। জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান অনিমেষ দে-র বক্তব্য, “আমাদের জেলায় শিক্ষকশূন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় কোথাও নেই। এক শিক্ষকের স্কুলে মাস্টারমশাইয়ের ব্যবস্থা করা আছে। সেগুলি স্থায়ী হয়নি নির্দেশ থাকায়। এ বার নির্দেশ হয়েছে। আমরা মাস্টারমশাইদের থেকে আবেদন নিয়ে শীঘ্রই ওটা স্থায়ী করিয়ে দেব।”

    এই জেলায় প্রাথমিকে গড়ে চার শতাংশ পড়ুয়া প্রতি শিক্ষাবর্ষে স্কুলছুট হয়। শিক্ষকশূন্যতা তার অন্যতম কারণ, মনে করছেন বামপন্থী সংগঠন এবিপিটিএ-র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক ধ্রুবশেখর মণ্ডল। তাঁর বক্তব্য, “অনেক স্কুলেই এক জন শিক্ষক। কোথাও স্থায়ী শিক্ষক নেই, অন্য স্কুলের শিক্ষক দিয়ে চলছে, কোথাও পার্শ্বশিক্ষক। এতে পড়াশোনা হয় না।” পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক শান্তনু দে-র পাল্টা দাবি, “রাজ্য সরকার চায়, শিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠু ভাবে চলুক। একটা পক্ষ আদালত-মামলা এ সব করে নিয়োগ প্রক্রিয়া বানচাল করছে। তবু এক শিক্ষকের স্কুলগুলিতে শিক্ষক দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)