• চা বাগানের ভরসা শিক্ষক ‘বাবলু মাস্টার’
    আনন্দবাজার | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • মা-বাবা হারানো অষ্টম শ্রেণির মেয়েটিকে হঠাৎ দেখা যাচ্ছিল না স্কুলে। স্কুল থেকে খবর পাঠানো হল ‘বাবলু মাস্টার’-কে। তিনি ছুটলেন মেয়ের বাড়ি। গিয়ে দেখেন, মা-বাবা নেই, মেয়েকে পড়াবে কে? আশেপাশের বাড়ির মহিলাদের ডেকে বৈঠক করলেন বাবলু। বললেন, “এ মেয়ে কি তোমাদের কেউ না? তোমরা ওর দায়িত্ব নেবে না?’’ চাঁদা তুলে ওই মহিলারাই দু’শো টাকা জোগাড় করলেন। স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে বললেন, ‘‘এই রইল পড়ার খরচ, আমরাই পড়াব ওকে।’’

    গত জানুয়ারিতে জলপাইগুড়ি অরবিন্দ মাধ্যমিক (উচ্চ মাধ্যমিক) স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে চা বাগানের সেই মেয়ে। প্রধান শিক্ষক ক্ষৌণীশ গুহ বলছেন, “ভাগ্যিস বাবলু ছেলে-মেয়েগুলোর খোঁজ রাখে! বাগানের কোনও ছেলে-মেয়ে স্কুলে না এলেই আমরা বাবলুকে খবর পাঠাই।”

    বাবলুকে ডাক পাঠান চা শ্রমিক মহল্লার ‘মুরুব্বিরাও’। ভান্ডিগুড়ি চা বাগান থেকে খবর এল, দু-তিন জন ছাত্র চা বাগানের শুকনো খালের ধারে বসে রোজ মাদকের নেশা করছে। বাবলু সেখানে পৌঁছে ছেলেদের নিয়ে গেলেন আদিবাসী সমাজ সংস্কৃতি কেন্দ্রে। সেখানে তারা ঢোল বাজানো শিখল। এখন যে কোনও উৎসবে ঢোল বাজায় তারা।

    আঠারো বছর বয়স হওয়ার আগেই কয়েকটি মেয়ের বিয়ের তোড়জোড় করছিলেন বাড়ির লোক। খবর পেয়ে বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের বোঝান বাবলু। মেয়েদের সদস্য করা হয় বাবলুর তৈরি আদিবাসী সাংস্কৃতিক দলের। সেখানে নাচ শেখে তারা। থাকে বাবলুর নজরে।

    আঠারোর নীচে ক’টা মেয়ের বিয়ে আটকালেন? কত ছাত্র-ছাত্রীকে স্কুলে ফেরত পাঠালেন? নেশা ছাড়ালেন কত পড়ুয়ার? বছর বিয়াল্লিশের বাবলু ওরাওঁ হাসেন। বলেন, “এখন আর আঠারোর নীচে বিয়ে হয় না। এই চা বাগান, পাশের বাগান ঘুরে দেখুন, সব বাড়ির ছেলে-মেয়ে স্কুলে যায়।”

    জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগানের ডাঙা লাইনে বাবলুর মাটির বাড়ি। বলেন, “মা এই চা বাগানে কাজ করতেন। সামান্য আয়। মাধ্যমিকের পরে পড়া ছেড়ে দিই।” তার পরে দূরশিক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ এবং ২০০৬ সাল থেকে সরকারি প্রাথমিকে শিক্ষক হিসাবে কাজ শুরু। মাস কয়েক আগে পাশের চা বাগানেরই প্রাথমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন।

    কাজের চাপ বেড়েছে কিন্তু তাতে দিনের রুটিন পাল্টায়নি বাবলুর। দিদি মালতি ওরাওঁ বলেন, “সকালে বেরিয়ে ভাই ফেরে রাতে। কখনও বাড়ির কাজ নিয়ে বেরোলেও হয়তো পাড়ার কোনও ছেলে-মেয়েকে পড়া দেখাতে চলে যায়।” জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের বিডিও মিহির কর্মকার ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগানের করম পুজো কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মঞ্চে গিয়েছিলেন। সে মঞ্চে বাবলুর সাংস্কৃতিক দল অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্বে ছিল। বিডিও বলেন, “ওঁকে দেখে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কাজে অন্যেরাও এগিয়ে আসুন।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)