প্রিয়জনকে দাহ করতে গিয়েও নিস্তার নেই। দফায় দফায় অর্থের দাবি। না দিলে শোকগ্রস্ত পরিবারকে হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, এ রকমই ‘অনিয়ম’ নিত্য ঘটে চলেছে কলকাতা পুরসভার অধীনস্থ শহরের প্রায় সমস্ত শ্মশানে।
যেমন, মরদেহের সঙ্গে হাসপাতালের পাঠানো কাগজে (রিলিজ় সার্টিফিকেট) স্ট্যাম্প করাতে পাঁচশো টাকা লাগবে। মৃত্যুর শংসাপত্রের (ডেথ সার্টিফিকেট) জন্য নাম নথিভুক্ত করাতে আরও এক হাজার টাকা! এর পরে রয়েছে চিতাভস্ম পাওয়ার খরচ। যা আরও বেশি। পাঁচ হাজার টাকার কম হলে কার চিতাভস্ম কাকে দিয়ে দেওয়া হবে, তা নাকি বোঝাই যাবে না। মরদেহ নিয়ে নিমতলা শ্মশানে শেষকৃত্য সারতে গিয়ে মৃতের আত্মীয় ও পরিজনদের এমনই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ।
আরও অভিযোগ, টাকা দিতে রাজি না হলে মরদেহ পড়ে থাকার হুমকি যেমন দেওয়া হচ্ছে, মৃত্যুর শংসাপত্র পেতে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াতে হবে বলে ভয়ও দেখানো হচ্ছে। অনেকেরই অভিজ্ঞতা, টাকা দিয়েও রেহাই নেই। মৃত্যুর শংসাপত্রের জন্য নাম নথিভুক্ত করাতে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। কারণ, ফর্মই মিলছে না শ্মশানের অফিসঘর থেকে। পাঁচ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে উল্টো দিকের চায়ের দোকান থেকে। মৃতের পরিজনদের জন্য তৈরি বিশ্রামকক্ষে যেতেও বাধা। অভিযোগ, সেখানে চাদর বিছিয়ে ঘুমোন, আড্ডা দেন শ্মশানের কর্মীরা।
কোভিডের সময়ে কলকাতার শ্মশানে আঁকশি দিয়ে মরদেহ টেনে নেওয়ার ঘটনায় শোরগোল পড়েছিল। মৃতের সম্মান নিয়ে সরব হয়েছিলেন অনেকে। প্রিয়জনের মৃত্যুর পরে শোকে বিহ্বল পরিজনেরও সম্মান ও সমবেদনা প্রাপ্য, এ নিয়ে একাধিক বার সরব হয়েছেন খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মরদেহ সৎকারের জন্য রাজ্য সরকারের ‘সমব্যথী’ প্রকল্প চালু রয়েছে। তাতে আর্থিক ভাবে দুর্বলদের মরদেহ সৎকারে সরকার সাহায্য করে।
সেই শাসক দলের অধীনে থাকা কলকাতা পুরসভার নিমতলা শ্মশানে ঘুরে দেখা গেল, মৃতের পরিজনদের থেকে টাকা তোলা-সহ অসহযোগিতার নানা ছবি। যেমন, গত ২০ অগস্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় অঞ্জু দাস নামে এক মহিলার। তাঁর পরিজনের অভিযোগ, প্রথমেই ‘রিলিজ় সার্টিফিকেট’-এ স্ট্যাম্প করিয়ে আনার জন্য পাঁচশো টাকা দাবি করা হয়। মৃতার পরিজনেরা ১০০ টাকা দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য, ‘‘এত কমে কী হবে! ৫০০ টাকা লাগবে।’’ শেষ পর্যন্ত রফা হয় দুশো টাকায়। দোতলার অফিসঘর থেকে একটি ফর্ম ধরিয়ে বাইরের চায়ের দোকান থেকে প্রতিলিপি করিয়ে আনতে বলা হয়। ওই দোকানে গেলে প্রতিলিপি করার বদলে পাঁচ টাকা দিয়ে ফর্ম কিনতে হয়। কিন্তু ফোটোকপি যন্ত্র কোথায়? ফর্ম কিনতে হবে কেন? মৃতের আত্মীয়ের প্রশ্নের উত্তরে দোকানি বলেন, ‘‘আপনার কাজ মিটলেই তো হল।’’ ফিরে এসে দেখা যায়, একই ব্যাপার ঘটছে লাইনে দাঁড়ানো সকলের সঙ্গেই।
যে ফর্ম শ্মশানের অফিস থেকেই দেওয়ার কথা, তা মৃতার আত্মীয়দের বাইরে থেকে কিনতে হবে কেন?
দাহকাজ শেষে চিতাভস্ম নিতে গেলে ঘিরে ধরলেন চার জন ডোম। বললেন, ‘‘পাঁচ হাজার লাগবে, এক টাকাও কম হলে কার অস্থিভস্ম কাকে দিয়ে দেব, তার দায় আমাদের নয়।’’ মৃত্যুর শংসাপত্র নিতে গেলে কমপক্ষে দু’হাজার টাকা দাবি করা হয়। এত টাকা কোথায়? পরিজনের আকুতি শুনে জানানো হল, স্ক্যানারে টাকা দেওয়ার সুবিধাও রয়েছে।
নিমতলা শ্মশান কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের অধীনে। পুরসভার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা রনিতা সেনগুপ্ত বিষয়টি শুনে বললেন, ‘‘দ্রুত খোঁজ করছি।’’ পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) তথা ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ বললেন, ‘‘শুনেই আমার অবাক লাগছে। নিজে এ সব বন্ধ করেছিলাম। কারা আবার এ সব শুরু করল? এখনই দেখছি। নিজে পরিদর্শনে যাব।’’