মহাসমারোহে প্যারিসে দুর্গোৎসব, বাঙালি ঐতিহ্যের অস্মিতায় ‘প্রেমের শহর’ হয়ে ওঠে ‘সিটি অফ জয়’
প্রতিদিন | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
অভিজ্ঞান মুখার্জি, প্যারিস: সকাল থেকে আকাশের মুখভার। মাঝেমধ্যে দুয়েক পশলা বৃষ্টিও হচ্ছে। শুনলাম কলকাতারও নাকি একই হাল। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। কে বলবে শরৎকাল? নীল আকাশের মধ্যে সেই ছোটবেলায় দেখা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ বেমালুম গায়েব। প্যারিসে এখন পাতা ঝরার মরশুম। আর তার মধ্যেই এখানে চলছে আগমনীর আয়োজন। মায়ের আসার যে সময় হয়ে গেল।
মা আসেন। দশভুজারূপে তিনি শুধু বঙ্গভূমিতে পা রাখেন না, তিনি আবির্ভূতা হন ইউরোপেও। ফ্রান্সও যে তাঁর কাছে মর্ত্যভূমি। দুনিয়ার যে প্রান্তেই বাঙালি আছে, সেখানেই বছরের কয়েকটি দিন শোনা যায় ‘বলো দুর্গা মাইকি’ ধ্বনি। আশ্বিনের শারদপ্রাতে যেন ‘কবিতার শহর, প্রেমের’ শহর প্যারিসের বাঙালিদের মনেও আলোকমঞ্জরী ফুটে ওঠে। বলো বলো দুর্গা এল। উৎসব কেবল মা দুর্গার নয়, বাকিদেরও ঘরে ফেরার দিন। আমাদের সবসময় ঘরে ফেরা হয়ে ওঠে না। তাই পুজোর সময় প্যারিসকেই আমরা ‘সিটি অফ জয়’ বানিয়ে ফেলি। গত কয়েক বছর ধরে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে প্যারিসে বাস। এই শহরেই এখন আমার ঘরকন্না। সকালে অফিস যাওয়ার সাক্ষী আইফেল টাওয়ার, আর সন্ধের সঁজেলিজে শোনায় প্রবাসের ঘরের ফেরার গান। তবু শরৎ মানেই নবীন প্রবীণের মেলবন্ধনের এক উৎফুল্ল অভিযান। দেশ বিদেশের বেড়া ভেঙে এই উৎসব আপামর বাঙালির মিলনের প্রাণকেন্দ্র। প্যারিসই বা ব্যতিক্রমী হবে কেন? এখানেও মিলনোৎসব উদযাপিত হয় স্থানীয় সংগঠন সম্মিলনীর হাত ধরে।
কী হয় না হয়, সেই খুঁটিনাটিতে আসব। তার আগে ছোট্ট করে পুজোর ইতিহাসটা বলে নিই। প্যারিসের দুর্গাপুজোর যাত্রা শুরু ১৯৮৭ সালে। মূকাভিনয় শিল্পী পার্থপ্রতিম মজুমদারের উদ্যোগে। সম্মিলনী নামক স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। সেসময় তাঁকে যোগ্য সহযোগিতা করেন এয়ার ইন্ডিয়া প্যারিসের তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার প্রভাস মজুমদার, চলচ্চিত্র সমালোচক ও শিক্ষাবিদ অজয় বসু, ভারতীয় শিল্প সংঘের বিশিষ্ট কর্তা প্রশান্ত লাহিড়ী, প্রখ্যাত গায়িকা কাকলি সেনগুপ্ত, শিক্ষাবিদ ড: বিকাশ সান্যাল এবং ড: নরেশ সেন। এই বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের প্রচেষ্টা ব্যতীত এই পুজো সম্ভব ছিল না। সকলে মিলে শুরু করেছিলেন প্যারিসের দুর্গাপুজো, বলা ভালো এক বিরাট মিলনমেলা।
সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত একই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে এই বঙ্গসমিতি। পুজোর দিনগুলিতে স্থানীয় বাঙালি-অবাঙালি সকলের কাছে অবারিত দ্বার। গত ৩৯ বছর ধরে সামগ্রিকভাবে সময় ও নির্ঘণ্ট মেনে এই পূজা হয়ে চলেছে। পুজোর নিরামিষ ভোগের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় না কেউই। সম্মিলনীর সদস্যরা নিজেদের হাতে ভোগ প্রস্তুত করে মাকে অর্পণ করেন। প্রতিদিন আগত সকল দর্শনার্থীদের মধ্যে সেই ভোগ বিতরণের দায়িত্বও নেন তাঁরাই। যেহেতু দূরদেশে প্রতি বছর প্রতিমা নির্মাণ বা আনা খুবই কষ্টসাধ্য, তাই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে প্রতিমা সংরক্ষণ করতে হয়। একই প্রতিমায় একাধিক বছর পুজো করা হয়। বর্তমানের প্রতিমাটি স্ফটিক নির্মিত। সাধারণত পৌরোহিত্যের দায়িত্ব যোগ্য সদস্যদের কাঁধেই বর্তায়। তবে প্রয়োজনে, স্থানীয় রামকৃষ্ণ মঠের মহারাজ বা প্রবাসী দক্ষিণী পুরোহিতদেরও সাহায্য নেওয়া হয়। উপস্থিত থাকেন ভারতের রাষ্ট্রদূতরাও।
এ তো গেল পুজোর কথা। তারপর তো ‘টুজো’ও থাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা স্থানীয় প্রবাসীদের উদ্যোগে মঞ্চস্থ হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একক প্রদর্শনী তো বটেই, স্বরচিত নাটকও এখানকার পূজার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর দুটি করে নাটক লেখা এবং দুদিন নিপুণভাবে মঞ্চস্থ করা একরকম অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। পুজোর আগের তিন চার মাস ধরে চলে এই নাটকগুলির রিহার্সাল। আর সঙ্গে লোভনীয় খাওয়াদাওয়া। সদস্যদের কাছে কোনটা যে বেশি আকর্ষণীয় তা বলা মুশকিল। ওই যে পুজো আসার আগে, পুজো আসছে আসছে যে অনুভূতিটা, শেষের কটা দিন সেটা মাতিয়ে রাখে। নাটকের কিছুটা দায়িত্ব এই প্রতিবেদকেরও উপর পড়ে। এছাড়া পুজোর সন্ধ্যায় শ্রুতিনাটক, নৃত্যনাট্য, আবৃত্তি, গান-নাচ সবই থাকে। এছাড়া দেশ থেকে মাঝে মাঝেই নানা গুণী শিল্পীর পদধূলি এই অনুষ্ঠানকে আরও গৌরবান্বিত করে। এই ‘টুজো’টা কিন্তু পুজোর থেকে কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সন্তানরা বড়ো হচ্ছে দেশ থেকে বহু দূরে। যাদের অনেকেই কোনোদিন চাক্ষুষ করেনি বাংলার দুর্গাপুজো। সেই নতুন প্রজন্মের জন্যই আরও বেশি করে প্রয়োজন পড়ে এই আয়োজনের। দুর্গাঠাকুরকে চিনতে শেখে তারা, শোনে পুরাণের গল্প। শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবি পরে সন্ধের আসরে গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর অবশ্যই সাক্ষী থাকে পাত পেরে খিচুড়ি খাওয়ার। পুজোর কদিনের প্যারিস আমাদের কাছে এক টুকরো বঙ্গভূমি হয়ে ওঠা। সেই অনুভূতিটা যেন আমাদের সন্তানরা না ভোলে, তার চেষ্টাও কিন্তু এই পুজোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বঙ্গভূমি বললাম ঠিকই, আসলে কিন্তু এই ক’দিন গোটা ভারতবর্ষ এসে আমাদের এখানে ধরা দেয়। শুধুমাত্র বাঙালিরাই নয়, অনেক ভিন্নভাষী ভারতীয়, এমনকী ফরাসিরাও আত্মিক বাঁধনে জড়িয়ে রয়েছেন প্যারিসের সবচেয়ে পুরনো এই পুজোর সঙ্গে। পুজো অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসের দক্ষিণে সিতে ইউনিভার্সিটির (বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস) মেইজঁ-দ্য-ল্যান্ড (ভারতীয় ছাত্র ভবন) প্রাঙ্গনে। সম্মিলনীর বর্তমান সভাপতি শ্রীমতি রুবি দত্ত এবং অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠদের তত্ত্বাবধানে সুনিপুণ ভাবে পরিচালিত হয় পুজোর যাবতীয় কর্মযোগ। প্রবাসী শিশুরাও এই উদ্যোগের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পুজোর কদিন ধরে নাচ, গান, আবৃত্তি, বসে আঁকো সবেতেই তাদের উদ্দীপনা আকাশচুম্বী। তবে আঁকার জন্য উৎসাহিত মানুষের কোনও নির্দিষ্ট বয়ঃসীমা নেই, তা ছড়িয়ে আছে তিন থেকে তিরাশির মধ্যে। এবং সকল ছবি পুজোর চারদিন টানা প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। উদ্যোক্তারাও নানান ভাবে শিশুদের সৃজনশীল মননকে উৎসাহ দিয়ে চলেন। অবশেষে দশমীতে সিঁদুর খেলা, ধুনুচি নাচ, মিষ্টিমুখে শেষ হয় উৎসব। বিদেশযাপন বলে এখন আর মনে হয় না, প্যারিসই আমাদের ঘরবাড়ি। আর এই পুজোটা সবার বাড়ির পুজো। বড্ড কাছে এনে দেয় বাংলার নদী-মাঠ-কাশফুলকে।
সারাবছর এই অনুভূতিটা নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি। দুর্গাপুজোয় ধর্মীয় আচারের পাল্লা ভারী নাকি সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর, তা তর্কসপেক্ষ। তবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে শারদোৎসব আমাদের কাছে এক উজ্জ্বল কণ্ঠহার। যাতে ভালোবাসার সুতোয় গাঁথা পড়ে বাঙালির ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৃজনশীলতা, এবং আধ্যাত্মবোধ। বাঙালির এই উৎসব নিছক পৌরাণিক অসুর সংহারের প্রতীকী নয়, বরং ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে বা ইস্কুলে শেখা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের একান্ত উপলব্ধি, সাবেকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়, মাতৃশক্তির বিজয় উদযাপন।
বিদেশ-বিভুঁইয়েও আমরা চেষ্টা করি জাতির সেই বহমান ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে। শারদোৎসব সেই বহমানতার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। নানা আচার, প্রকরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পূজার বিধিনিয়মগুলি যুগ যুগ ধরে এই ধারাবাহিকতার মাধ্যম মাত্র। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই সম্পদটুকু পরবর্তী প্রজন্মকে হস্তান্তর করা আমাদের কর্তব্য। এবং সর্বোপরি মা যখন পুত্র-কন্যা-বাহন-অসুর সহযোগে গোটা বাস্তুতন্ত্রকে সঙ্গে নিয়েই আসেন, আমরা, প্যারিসের বাঙালিরা, তাঁর অভ্যর্থনায় অস্মিতার কার্পণ্য কীভাবেই বা করতে পারি?
(লেখক প্যারিসে ব্যাঙ্কে কর্মরত এবং প্যারিস সম্মিলনীর সক্রিয় সদস্য)