• অবসরের পর বিনা পারিশ্রমিকে ১৪ বছর শিক্ষকতায়, পড়ুয়াদের প্রিয় রাইপুর হাই স্কুলের শিক্ষক ফটিকচন্দ্র
    প্রতিদিন | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • অসিত রজক, বিষ্ণুপুর: ঘণ্টা বাজতেই ক্লাসরুমে এসে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মুখে ‘গুড মর্নিং’ শোনার পরই একগাল হেঁসে ৮০ বছরের ফটিকচন্দ্র খাঁ। তিনি বলেন, ‘‘ওরে তোরা জানিস কীভাবে সম্রাট আকবর ছদ্মবেশে সাধারণের সমস‌্যা জেনে সমাধান করত? বীরবল কিভাবে আকবরের সভায় নবরত্নের মধ্যে একজনের জায়গা করে নিয়েছিলেন?’’ এভাবেই পলাশির যুদ্ধ বা সিপাই বিদ্রোহও জীবন্ত তাঁর পড়ানোর ভঙ্গিতে। পড়ানোটাই যে তাঁর প‌্যাশন। যা অবসরের ১৪ বছর পরও একইভাবে ধরে রেখেছেন। বিনা পারিশ্রমিকে রোজ ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে স্কুলে আসেন। তাই অবসর নিলেও ঘরে বসে দিন না কাটিয়ে নিজের স্কুল গড় রাইপুর হাইস্কুলে শিক্ষার্থীদের নিজের সবটা উজার করে দিয়ে চলেছেন ফটিকচন্দ্র খাঁ। শিক্ষর্থীদের হৃদয়ে করে নিয়েছেন এক আলাদা জায়গা। শুক্রবার শিক্ষক দিবসে গড় রাইপুর হাইস্কুলের সকলেই স্যালুট জানাচ্ছে তাঁদের প্রিয় ‘ফটিকবাবু’-কে।

    ১৯৭৯ সালে বাঁকুড়ার রাইপুর ব্লকে নিজের স্কুল ‘গড় রাইপুর হাইস্কুলে’ ইতিহাস শিক্ষক হয়ে যোগ দিয়েছিলেন ফটিকবাবু। অবসর নেন ২০১২ সালে। কিন্তু তারপরও স্কুলে আসা বন্ধ করেননি। প্রতিদিন দুটো ক্লাস নেন। দরকার পড়লে তিনটে ক্লাসও তিনি নেন। স্কুলের সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ দেন, ছাত্রছাত্রীদের মন জয় করেন নিজের আন্তরিকতায়। তিনি পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা বিভাগ দেখাশোনা করেন। একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণি ইতিহাস বিভাগই তিনি পড়ান। তবে দীর্ঘ চাকরিজীবনের পরেও ফটিকবাবুর স্ত্রী ও মেয়েদের উৎসাহ ও শিক্ষকতার প্রতি টানই তাঁকে আজও বিদ্যালয়ে টেনে আনে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মধুসূদন মণ্ডল বলেন, “ফটিকবাবু আমাদের গর্ব। অবসর নেওয়ার পরও নিয়মিত ক্লাস নিয়ে সহযোগিতা করেন। উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি আমাদের পাশে থাকেন। বিদ্যালয়ের নানা কর্মসূচিতে তাঁর ভূমিকা অনন্য। উনি আমাদের অভিভাবক হিসেবে সর্বদা আমাদের পাশে থাকেন ঠিক ভুল তিনি বিবেচনা করেন। আজকে আমি এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকতার কাজ করছি মাধ্যমিকের সময় আমি এই স্কুলেই পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম। সেই সময় উনি এই স্কুলেরই শিক্ষক ছিলেন সঙ্গে হস্টেলের দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।’’

    বর্তমান স্কুলের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক তথা ফটিকবাবুর প্রাক্তন ছাত্র চন্দন ঘোষ বলেন, “এই সময়ে বিনা পারিশ্রমিকে কেউ কাজ করে না। কিন্তু ফটিকবাবু শুধুমাত্র স্কুল ও ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসেন বলেই প্রতিদিন ক্লাস নিতে আসেন। আমরা গর্বিত, উনি আমাদের শিক্ষক।’’ শিক্ষার্থীদের কাছেও ফটিকবাবুর আলাদা ভালোবাসা রয়েছে। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়া কর বলেন, “স্যার খুব যত্ন করে পড়ান। অবসরের পরেও স্কুলে আসেন, এটা আমাদের জন্য বড় সৌভাগ্য। এছাড়াও স্কুলের যেকোনও অনুষ্ঠান হোক বা যে কোন ওকাজ তিনি সর্বদা আমাদেরকে পাশে থেকে করার সাহস দেন।’’ দশম শ্রেণির ছাত্র অলিক মহাপাত্র জানিয়েছে, তার বাবাও ফটিকবাবুর ছাত্র ছিলেন। এখন সেও তাঁর ছাত্র। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর শিক্ষা ও মূল্যবোধে গড়ে উঠছে। বাবা এবং মায়ের মুখে স্যারের অনেক নাম শুনেছি। কিন্তু তিনি যে সত্যি কতটা ভালো পড়ান সেটা আমি যদি না পড়তাম তাহলে হয়তো জানতামই না বাবা মায়ের কথাটা কতটা সত্যি।

    ফটিকবাবুর কথায়, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসা, খুনসুটি, কোলাহল, মন থেকে কাছে ডাকা এবং সহকর্মীদের ভালোবাসা এসব ছাড়তে চাই না। পারিশ্রমিকের কোনও কথাই উঠে না। যতদিন শরীর সুস্থ থাকবে ততদিন নিয়মিত স্কুলে আসব। আমার স্ত্রী ও আমার মেয়েরা আমাকে উৎসাহ দেয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এই স্কুলে আমি পড়েছি। আমার প্রধান শিক্ষক দেবীরাজ চট্টোপাধ্যায় আমার প্রেরণা। এই স্কুলে যুক্ত হওয়ার পরেও আমার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে চাকরি সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু উনি সেই সময় উনি আমাকে বলেছিলেন তুই এই স্কুল থেকে অন্য চাকরিতে যাবি না। আর এই শিক্ষকতাকে কোনদিনও চাকরি হিসেবে নিবি না। সেদিন থেকেই এই স্কুলে আমি থাকব এবং এখানেই শিক্ষকতা করব স্থির করেছিলাম।’’
  • Link to this news (প্রতিদিন)