৫১৬ বছর আগে নরবলি দিয়েই শুরু হয় জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির দুর্গাপুজো
বর্তমান | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, জলপাইগুড়ি: পাঁচ শতাধিক বছর আগের কথা। নরবলি দিয়েই শুরু হয়েছিল জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির দুর্গাপুজো! খেলার ছলে মাটির দলাকে প্রতিমা বানিয়ে প্রথম মা দুর্গা রূপে পুজো করেছিলেন দুই ভাই বিশ্ব (বিশু) সিংহ ও শিষ্য (শিশু) সিংহ। আর সেই পুজোতেই নাকি ছাগশিশু কল্পনা করে বলি দেওয়া হয়েছিল এক বালককে! বলির রক্তে ভেসে গিয়েছিল চারপাশ। বলা হয়, দেবী দুর্গার আশীর্বাদে পরবর্তীতে বিশ্ব সিংহ কোচবিহারের রাজা হন। আর শিষ্য সিংহ জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুরে এসে নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা হয়েও তাঁরা দুর্গাপুজো বন্ধ করেননি। বরং আরও ধুমধামের সঙ্গে ওই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। শুধু বন্ধ হয়ে যায় নরবলি। যদিও জলপাইগুড়ির রাজবাড়িতে এখনও বলির রেওয়াজ বহমান। হাঁস, পায়রা, পাঁঠা, চালকুমড়ো ও আখ বলি দেওয়া হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী চারদিনে বলি দেওয়া হয় চারটি পাঁঠা। তবে এখনও অষ্টমীর মাঝরাতে চার জোড়া পায়রা বলির সময় মন্দির চত্বরে থাকতে দেওয়া হয় না কোনও বাইরের লোক। মন্দিরের চারদিক ঘিরে শুধুমাত্র রাজ পরিবারের সদস্য আর পুরোহিতের উপস্থিতিতে হয় ওই বলি। সঙ্গে চালের গুঁড়ো দিয়ে মানুষের আকৃতি গড়ে বলি দেওয়া হয় কুশ দিয়ে।
রথের উপর অধিষ্ঠিত থাকেন জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির কনকদুর্গা। দেবী তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা। অর্থাৎ, তাঁর গায়ের রং গলানো সোনার মতো। এখানে মা দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহের সঙ্গে থাকে বাঘ। সেই বাঘের গায়ের রং সাদা। জনশ্রুতি, বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে একসময় সাদা বাঘের দেখা মিলত। সেকারণে ওই প্রাণী রাজবাড়ির দেবীর বাহন হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। মা দুর্গার সঙ্গে তাঁর চার সন্তানের পাশাপাশি একচালিতে থাকেন জয়া-বিজয়া, মহাদেব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মা চণ্ডী ও দেবী মহামায়া।
মৃন্ময়ীর পুজো চালুর পাশাপাশি রাজা বিশু সিংহ ও শিশু সিংহ তিনটি সোনার দুর্গা গড়েছিলেন। যার একটি কোচবিহার রাজবাড়ির মন্দিরে। দ্বিতীয়টি জলপাইগুড়ি রাজবাড়িতে। কিন্তু তৃতীয় মূর্তিটি কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বলা হয়, ওই স্বর্ণদুর্গা রাজবাড়ি থেকে কোনওভাবে চুরি যায় কিংবা হারিয়ে যায়। পরে সেটি উদ্ধার হয় ময়নাগুড়ির খয়ের খাল থেকে। এখন ওই মূর্তি ময়নাগুড়িতেই রয়েছে। সারাবছর রাজবাড়ির অন্দরে পুজো পায় সোনার দুর্গা। মহালয়ায় নাটমন্দিরে দেবীর চক্ষুদানের পর আঁটোসাঁটো নিরাপত্তায় স্বর্ণমূর্তি নিয়ে আসা হয় নাটমন্দিরে। পুজোর চারদিন মৃন্ময়ী মূর্তির পাশাপাশি পুজো হয় সোনার দুর্গারও। জলপাইগুড়ির আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক উমেশ শর্মা বলেন, বিশু সিংহ ও শিশু সিংহ দুই ভাই খেলার ছলে মা দুর্গার পুজো শুরু করেছিলেন। সেই পুজোয় এক বালককে ছাগশিশু রূপে বলি দেওয়া হয়, এমনটাই জনশ্রুতি। এই পুজো এবার ৫১৬ বছরে পা রাখল। রাজ পরিবারের কুলপুরোহিত শিবু ঘোষাল বলেন, জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় একসময় নরবলি হতো। এখনও পাঁঠা, পায়রা, চালকুমড়ো বলির পাশাপাশি ও চালের গুঁড়ো দিয়ে মানুষের আকৃতি গড়ে কুশ দিয়ে বলি দেওয়া হয়। -ফাইল চিত্র