• বেলপাহাড়ী: দৈব আদেশে পুজো শুরু করেন ভূমিপুত্র সহদেব সিং, মন্ত্র লিখে দেন স্বয়ং দেবীই
    বর্তমান | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • প্রদীপ্ত দত্ত, ঝাড়গ্ৰাম: বেলপাহাড়ীর অরণ্য ঘেরা গ্ৰাম প্রতিরাজগুরা। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ ভূমিজ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের। তাঁরা অরণ্যদেবীর আরাধনা করেন। স্থানীয় বাসিন্দা বছর ষাটের সহদেব সিং স্বপ্নাদেশ পেয়ে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। দেবীর অলৌকিক নির্দেশে রচিত হয়েছিল পুজোর মন্ত্র। দশমীতে নয়, দেবী দুর্গা অষ্টমঙ্গলা করে কৈলাসে ফিরে যান। পুজোর চারদিন গ্ৰামের বাসিন্দারা নিরামিষ খাবার খান। 

    গ্ৰামবাসীদের কাছে দেবী দুর্গা অরণ্যের দেবী। ভূমিজ সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বাস, দেবী তাঁদের হাতে পূজিত হতে চেয়েছিলেন। সেই কারণেই চল্লিশ বছর আগে তরুণ সহদেব সিংকে পুজো করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কোন মন্ত্রে  পুজো হবে তাও লিখে দিয়েছিলেন। সেই মন্ত্রেই হয় দেবীর আরাধনা। অরণ্য দেবীর এই পুজোর কথা জেলার সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। পুজোর সময়ে ভক্ত সমাগমে গ্ৰামে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। সহদেববাবু গ্ৰামের বাসিন্দাদের কাছে গাছবুড়ো নামে পরিচিত। অরণ্যের শতাধিক ওষধি গুণযুক্ত গাছগাছড়ার সন্ধান জানেন। সেইসব গাছের সন্ধানে তরুণ বয়সে একা একা অরণ্যে ঘুরে বেড়াতেন সহদেব। অরণ্যের গাছপালা পশুপাখিদের নিয়ে কবিতা লিখতেন। জঙ্গল ছিল তাঁর ঘরবাড়ি। এক নিশীথে ঘরের উঠোনে লম্ফের আলোয় কবিতা লিখছিলেন তিনি। সেইসময়ে হাতের কলম সাদা কাগজে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাতার পর পাতা লিখতে শুরু করে। আতঙ্কিত সহদেববাবু ঘোরের মধ্যে এক দৈববাণী শুনতে পান—‘রচিত এই মন্ত্র দিয়ে তুমি এই গ্ৰামে আমার পুজোর সূচনা করবে।’ পরের দিন আলো আঁধারি ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, খাতার একাধিক পাতা নানা লেখায় ভরে উঠেছে। যে লেখার বিষয়ে তিনি আগে কিছুই জানতেন না। কিছু লেখা বুঝতে বুঝতে পারলেও আজও বেশকিছু লেখার মর্মোদ্ধার করে উঠতে পারেননি। নিজ হাতে দেবীর প্রতিমা তৈরি করে সেই বছর দেবী দুর্গার আরাধনা করে। সহদেববাবু বলেন, তরুণ বয়সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল। জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। বৃক্ষদের বন্ধু মনে হতো। জঙ্গলের পশুপাখিরা নির্ভয়ে পাশ দিয়ে চলে যেত। আমাকে কিছু করত না। গভীর রাতে জঙ্গল, পশুপাখিদের নিয়ে কবিতা লিখতাম। কুড়ি বছর বয়সে এক রাতে আমার হাতের কলম যেন নিজে থেকেই লিখতে শুরু করেছিল। সেইসব বিষয়ে কিছুই জানতাম না। আগে কখনও শুনিনি। আধজাগা অবস্থায় দৈব নারীকণ্ঠ শুনেছিলাম। গ্ৰামে দুর্গার প্রতিমা তৈরি করে পুজো করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ মেনে চল্লিশ বছর ধরে দেবীর পুজো করে চলেছি। খাতার মধ্যে দেবীর রচনার সব মানে আজও বুঝে উঠতে পারিনি। দেবী বলেছিলেন, এই গ্ৰামে অষ্টমঙ্গলা করে কৈলাসে ফিরবেন। দেবী যে হিংসার বিরুদ্ধে, এইটুকু বুঝতে পেরেছি। পুজোর সময় গ্ৰামে আমিষ রান্না করা হয়না। গ্ৰামের সকল বাসিন্দা এই প্রথা এখনও মেনে চলেন। পুজোয় দেবীর কাছে বারবার প্রার্থনা করি, দেবী তোমার লেখার সকল মর্ম আমায় বলে দাও। প্রকৃতির ও মহামায়ার শক্তিকে বোঝে কার সাধ্য। সহদেববাবুর ছেলে নির্মল সিং বলেন, বাড়িতে প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। পুজোর আয়োজন কষ্ট করে করা হয়। দেবীর নির্দেশে এই পুজো হয়। বন্ধ করার যে কোনও উপায় নেই। বাবা এত বছর ধরে দেবীর কাছে আকুল প্রার্থনা করে চলেছেন, মন্ত্রের মর্মদ্ধার করার। অরণ্যের দেবী নিশ্চয় তা বুঝিয়ে দেবেন।
  • Link to this news (বর্তমান)