• বিপুল তরঙ্গ রে!
    আনন্দবাজার | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • অনিন্দ্য জানা

    আইটিসি রয়্যাল বেঙ্গলের দ্রুতগামী লিফ্‌ট হু-হু করে নামছে লবির দিকে। কে জানে কত তলা থেকে! এই সময়টা খুব অস্বস্তির। কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। কী বলি-কী বলি ভাবতে ভাবতেই সময় শেষ হয়ে যায়। অতএব আমি এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্য দু’জনেই একলা এবং মৌনী দাঁড়িয়ে।

    ২০২৩ সালের ‘বছরের বেস্ট’ শুরু হবে কিছুক্ষণ পরে। আনন্দবাজার ডট কম-এর অনুষ্ঠানে অনির্বাণ এসেছেন শুরুর গানটা গাইবেন বলে। তার আগে হোটেলের ঘরে মঞ্চের সঙ্গী গিটারিস্টের সঙ্গে খানিক টুং-টাং করে ব্যাপারটা ঝালিয়ে নিতে গিয়েছিলেন। সাদা কুর্তা-পাজামার অনির্বাণ মোবাইলে খুলে রেখেছেন ‘বাঁধ ভেঙে দাও’। মন্দ্রকণ্ঠে মহড়া দিচ্ছেন। মন্দ লাগছিল না। আমি তাঁর ‘শাজাহান রিজেন্সি’ ছবিতে গাওয়া গানটি (কিচ্ছু চাইনি আমি) শুনেছি। স্পষ্ট উচ্চারণ। খানিক ঝিম-ধরা গায়নভঙ্গি। ছবিটি দেখিনি। ফলে ঠিকঠাক বলতে পারব না। তবে মনে হয়েছে, ছবিতে যেখানে গানটা ছিল, সেখানে নিশ্চয়ই ওই ভঙ্গিটাই চাইছিল। অনির্বাণ পরিচালিত ‘মন্দার’ ওয়েবসিরিজ় দেখে মনে হয়েছে, পরিচালক হিসাবে তিনি খুঁটিনাটির প্রতি মনোযোগী। মনে হয়েছে, পরিচালক অনির্বাণ তারকাদের চেয়ে বেশি অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতে চান।

    অনির্বাণের সঙ্গে আনন্দবাজার ডট কম-এর অধুনালুপ্ত ফেসবুক লাইভ শো ‘অ-জানাকথা’-র একটা এপিসোড করেছিলাম। ব্যাকব্রাশ চুল, লম্বা জুলপি, কানে দুল, চোখে চশমা, স্পষ্ট উচ্চারণ, কেটে কেটে কথা বলেন। সব বিষয়ে নিজস্ব মতামত আছে এবং সেটা যথেষ্ট জোরালো। সেই সুবাদেই জেনেছিলাম অনির্বাণ আদতে মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা। আমাদের মতোই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। যেমন আমরাও আমাদের পছন্দের বিষয়-টিষয় নিয়ে করেছি। ২০১০ সাল থেকে কলকাতার পেশাদারি মঞ্চে কাজ করা শুরু করেন। ক্রমশ তাঁর কাজ তাঁকে আরও দূরের আকাশে নিয়ে যায়। অর্থাৎ, আমাদের মতো পাঁচপেঁচি সাধারণ মানুষের থেকে তাঁকে আলাদা করে দেয়। তিনি খ্যাতনামী হন এবং টালিগঞ্জের শিল্পীমহলে প্রথম সারিতে বসার ডিস্টিংশন লাভ করেন।

    কয়েকবার আলগা কথা বলে মনে হয়েছে অনির্বাণ মেধাবী অভিনেতা। প্রতিভার অধিকারী। গলায় একটা দার্ঢ্য থাকায় গানটা মন্দ করেন না। পেশাদার। তবে পাশাপাশি এ-ও মনে হয়েছে যে, অনির্বাণ প্রখর বুদ্ধি ধরেন। কখন কোথায় কী বলতে হবে জানেন। কখন কোথায় কী বলতে হবে না, তা-ও জানেন। সুযোগ পেলে সমাজ-রাজনীতি-নীতি-নৈতিকতা নিয়ে জ্ঞান দিতে চান। তেমন একটা গুহ্য বাসনা তাঁর ভিতরে রয়েছে। যাঁরা এটা মনে করেন, তাঁরা সম্ভবত অনবধানে ভাবতে থাকেন, উল্টোদিকের লোকটা তাঁর কথাটা ঠিকঠাক বুঝতে পারছে তো? তাই বেখেয়ালে খানিকটা মুদ্রাদোষের মতো বলতে থাকেন, ‘‘ব্যাপারটা বুঝলেন তো?’’ অনির্বাণও বলেন।

    আমি যেটা মোটামুটি বুঝতে পারি, অনির্বাণ তাঁর শ্রোতা এবং দর্শককে এক গভীর জীবনবোধের পাঠ দিতে চান। তার মধ্যে খানিক স্বভাবসুলভ রসবোধও থাকে। মনে হয় অনির্বাণ মনে করেন, বাঙালিদের জীবনে রসিকতাটা (খানিকটা স্যাটায়ার-ঘেঁষা) ক্রমশ কমে আসছে। ঠিকই মনে করেন। কিন্তু শেষমেশ জ্ঞানের লাইনে চলে যান। হাজার হোক, তিনিও তো, যাকে বলে বাঙালিই। তাঁর ব্যান্ড ‘হুলিগানইজ়ম’-এর ‘মেলার গান’টি যেমন। প্রথম চার লাইন বেজায় ভাল (যা নিয়ে ‘রিল’ তৈরি না করলে সমাজে পতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বলে মনে হয়। বিদ্যা বালনও সে মায়া এড়াতে পারেননি)। কিন্তু শেষদিকটা সেই জীবন-মরণ সংক্রান্ত জ্ঞানগর্ভ পথে চলে গেল।

    তবে অনির্বাণের দোষ নেই। ‘অডিয়েন্স’ পেলে কে না জ্ঞান দিতে চান! এলি-তেলি-যোগিতাবালি (এদানি মানহানির মামলার মঞ্চে ডিস্কো ডান্স-রত মিঠুন চক্রবর্তী দোষ নেবেন না আশা করি। এ নেহাতই প্রচলিত ফিচেল প্রবাদ) সকলেই শ্রোতা পেলে বকম-বকম শুরু করেন। অনির্বাণ তো তাঁদের তুলনায় অনেক কৃতবিদ্য। ফলে জ্ঞান তিনি দিতেই পারেন। আর সে জ্ঞান নেওয়ার জন্যেও খুব কম লোক মুখিয়ে নেই।

    তো সেই পটভূমিকায় অনির্বাণদের (গৌরবে বহুবচন) গাওয়া একটি গান (‘তুমি মস্তি করবে জানি’) সম্প্রতি সমাজে এবং জনমানসে বিপুল তরঙ্গ তুলেছে। যে তরঙ্গের ঢেউ আছড়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। কেউ কেউ বিস্তর আমোদ পেয়েছেন। আবার অনেকে অনির্বাণকে ঝেড়ে গালমন্দ করছেন। মূল বক্তব্য, আরজি কর আন্দোলনের সময় তো বাপু মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলে! এখন রাজনীতিকদের নিয়ে রঙ্গ-তামাশা করতে এসেছ কেন?

    অনির্বাণ বলছেন, শেষবার (এবং ওই একবারই। জীবনে প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত শেষ) তিনি মিছিলে গিয়েছিলেন সিএএ-এনআরসি বিতর্কের সময়। তখনই বুঝেছিলেন, আন্দোলন করতে গেলে সবসময় সেটা নিয়েই থাকতে হবে। একটু মিছিল করলাম, একটু নিজের ছবির প্রমোশন করলাম, একটু বিজ্ঞাপনের কাজ করলাম, একটু ফেসবুকে পোস্ট করলাম— এসব সাড়ে বত্রিশ ভাজার সঙ্গে জড়িয়ে থাকলে আন্দোলনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা যায় না। এসব করে আন্দোলন হয়ও না। অতএব, তিনি আরজি কর আন্দোলনের সময় নীরব ছিলেন। যদিও রাতদখলের রাতে তিনি সারা রাত ঘুমোতে পারেননি! এমনই এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল সে রাতে।

    অনেকে বলেছেন, টালিগঞ্জের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি (মূলত স্বরূপ বিশ্বাস-কৃত) নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করতে যাওয়ায় তাঁকে নিয়ে আর কেউ কাজ করতে চাইছেন না। অর্থাৎ, তিনি খানিকটা ‘একঘরে’ হয়েছেন। তাই এমন একটি ‘রাজনীতিক’ গান ফেঁদে শাসকশিবিরের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

    অনির্বাণ বলছেন, আদৌ তা নয়। তাঁর ছবিতে অভিনয় করা কেউ আটকাতে পারবে না। তিনি এখনও শুট করছেন। ভবিষ্যতেও করবেন। গানও বানাবেন তাঁর ব্যান্ডের জন্য।

    বেশ। তবে অনির্বাণদের যে ব্যান্ডের যে গান নিয়ে বঙ্গসমাজ মাধ্যমে এত হিল্লোল উঠেছে, সেটিকে প্রাথমিক ভাবে ‘গান’ বলা যায় কি না, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। ঝিঙ্কুনাকুর শব্দ প্রক্ষেপণের মধ্যে পরপর শব্দ সাজানো একটা মজারু লিফলেটও বলা যায়। ফর্ম্যাটটা খানিক ছড়া, খানিক আখড়াই, খানিক খেউড়, খানিক তরজা, খানিক কবিগান আর অনেকটা বিশুদ্ধ খিল্লি। এবং সেই খিল্লি মূলত তিন রাজনীতিককে নিয়ে। কুণাল ঘোষ, দিলীপ ঘোষ এবং শতরূপ ঘোষ। তিন ‘ঘোষ’-এর প্রথমজন তৃণমূল, দ্বিতীয় বিজেপি এবং তৃতীয় সিপিএম। ‘মূলত’ এই তিনকে নিয়েই হল্লাগুল্লা। ওই হাফ-গানে প্রধানমন্ত্রীর প্রসঙ্গও আছে। যেমন আছে ‘এসআইআর’ প্রসঙ্গ। কিন্তু তা নিয়ে কোনও পরিসরে কোনও আলোচনা নেই। যেমন আলোচনা, মতামত, বিতর্ক, প্রতর্ক নেই তথাকথিত গানটির বাকি অংশ নিয়েও। বস্তুত, ঘটনাপ্রবাহ বলছে, সেই অনুষ্ঠানে অনির্বাণদের ব্যান্ড মোট সাতটি গান গেয়েছিল। শেষ গানটির কথা এইরূপ— ‘চলো বানাই ভালবাসার দেশ, ভালবাসা রোজকার অভ্যেস’। কিন্তু সে গান কোনও ভালবাসা পায়নি। ক’জন জানেন, তা নিয়েও গভীর সন্দেহ আছে।

    প্রসঙ্গত, সংশ্লিষ্ট গানটি (আদতে ‘গান’ না হলেও লেখার সুবিধার্থে ‘গান’ই বলি) লেখা হয়েছিল ১০ বছর আগে। দেশের তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে। অনির্বাণই জানিয়েছেন, সে গানের বিষয় ছিল দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়ের প্রেম। পরে ছেলেটি গণপ্রহারে মারা যায়। সেই প্রসঙ্গ এই গানে নেই। না থাকারই কথা। কারণ, অনির্বাণ বুদ্ধিমান। তিনি এই গানে ঘোষেদের অনুপান মিশিয়েছেন। এবং এমন তিন ঘোষকে ঘষেছেন, তাঁরা প্রথমত, রাজনীতি করলেও যথেষ্ট ‘স্পোর্টিং’ (যার প্রমাণ তিনজনেই দিয়েছেন)। দ্বিতীয়ত, যাঁদের নিয়ে জনমানসে কৌতূহলের পাশাপাশি খানিক বিনবিনে অসূয়াও রয়েছে। কেন কুণাল ‘জেলখাটা’ হয়েও ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সর্বত্র বিরাজমান, কেন কুণাল একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উস্তুম-কুস্তুম কটাক্ষ করেও এখন মমতার দলেরই অন্যতম মুখপাত্র, কেন তাঁকে চ্যানেলে-চ্যানেলে দেখা যায় ইত্যাদি। দিলীপ সম্পর্কে সমাজের বীতরাগের কারণ আবার আলাদা। কেন তিনি ষাট বছরে বিয়ে বসলেন, কেন তিনি বিভিন্ন সময়ে আলফাল বকেও ‘ফুটেজ’ পান, কেন তিনি বিজেপির কোনও পদে না থেকেও এত গুরুত্ব পান ইত্যাদি। শতরূপের প্রতি অসূয়ার একটা কারণ যদি হয় তাঁর রূপ, তা হলে অন্য কারণ নিশ্চয়ই ‘শূন্য’ সিপিএমের নেতা হয়েও বিভিন্ন মাধ্যমে গুরুত্বপ্রাপ্তি। সেই সূত্রেই তাঁর বাইশ লাখি গাড়ি চড়াটাও একটা কারণ বইকি!

    তবে কারণ যা-ই হোক, নির্যাস একটাই— এঁরা তিনজনেই ‘প্রিভিলেজ্‌‌ড’ শ্রেণির। অর্থাৎ, এঁরা তিনজনেই ‘বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত’ বলে সমাজে পরিগণিত। এবং তিনজনেই ধরাছোঁয়ার মধ্যে। অতএব, দাও ঠুসে! আরও একটা মিল আছে। তিনজনেই খানিক ‘সফ্‌ট টার্গেট’। সেটা যেমন অনির্বাণেরা ভেবেছেন, তেমনই জনতাও ভেবেছে। সেখানেই দুইয়ের সুর-তাল-লয় মিলেছে। সেই কারণেই বিপুল তরঙ্গক্ষেপ। অনির্বাণ অবশ্য জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে তাঁদের গানে মমতা, শুভেন্দু অধিকারী, মহম্মদ সেলিম বা অনুরাগ ঠাকুরদের মতো নাম এবং চরিত্রেরাও আসবেন। হয়তো আসবেন। হয়তো আসবেন না। কিন্তু এই তিন ঘোষকে দিয়ে একেবারে নাম করে রাজনীতিকদের খিল্লি করার প্রক্রিয়ার (রাজনীতিকদের ঠুকে আগেও অনেক গান হয়েছে। কিন্তু সেটা গোষ্ঠী হিসাবে। একেবারে নাম-টাম করে হয়েছে বলে মনে পড়ছে না) একটা ‘সফ্‌ট লঞ্চ’ তো হয়ে গেল। নাকি?

    কিন্তু এর বাইরেও একটা নিহিত সত্য রয়ে গেল। অনির্বাণদের গান নিয়ে যে আলোচনা এবং বিতর্ক চলছে, তার আবডালে সম্ভবত এই সত্যটি চাপা পড়ে যাচ্ছে যে, আমাদের আশপাশের রাজনীতিকদের নিয়ে লঘু এবং চপল ঠাট্টাতামাশা করলেই দ্রুত ‘ভাইরাল’ হওয়া যায় (অনির্বাণ নিজেও জানাচ্ছেন, এত চটপট এত ভাইরাল হওয়ার এমন অভিজ্ঞতা তাঁর এর আগে হয়নি)।

    সেই নিহিত সত্য বলছে, রাজনীতিকদের প্রতি আস্থার লিফ্‌ট সোঁ-সোঁ করে দ্রুত পতনোন্মুখ। অনির্বাণেরা তাঁদের নিয়ে খিল্লি করছেন, রগড় করছেন। আমরা সেই বিপুল তরঙ্গের আমোদে গা ভাসাচ্ছি।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)