আজকাল ওয়েবডেস্ক: জাতীয় হিসাব বিভাগ (National Accounts Division) প্রকাশিত জুন ত্রৈমাসিকের জিডিপি তথ্য অর্থনীতির বৃদ্ধির হারে চমকপ্রদ উল্লম্ফন দেখিয়েছে। সরকারি প্রেস নোট অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে (২০২৫–২৬ অর্থবছরের Q1) জিডিপি বৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭.৮ শতাংশে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫ শতাংশ এবং ২০২৪–২৫-এর শেষ ত্রৈমাসিকে ৭.৪ শতাংশ। কিন্তু পরিসংখ্যানের ভেতরে তাকালে স্পষ্ট হয়, এই উল্লম্ফনের ভিত অনেকটাই দুর্বল এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক পুরোপুরি অনুপস্থিত।
কোন খাত টেনে তুলল জিডিপি?
অপ্রত্যাশিত এই বৃদ্ধির মূল ভরসা হলো তৃতীয়ক (tertiary) খাত। গত বছরে যেখানে এই খাতের বৃদ্ধি ছিল ৬.৮ শতাংশ, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩ শতাংশে। বিপরীতে, দ্বিতীয়ক খাতের বৃদ্ধি নেমেছে ৮.৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে এবং প্রাথমিক খাত সামান্য উন্নতি করে ২.২ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
প্রাথমিক ও দ্বিতীয়ক খাতের প্রধান উপাদানগুলির অধিকাংশেই পতন বা স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। খনন ও পাথর উত্তোলন (mining and quarrying) খাত গতবারের ৬.৬ শতাংশ বৃদ্ধির থেকে এবার নেমেছে মাইনাস ৩.১ শতাংশে—অর্থাৎ ৯.৭ শতাংশের টার্নঅ্যারাউন্ড। বিদ্যুৎ, গ্যাস, জল সরবরাহ ও অন্যান্য ইউটিলিটি পরিষেবা খাতেও ১০.২ শতাংশ থেকে পড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.৫ শতাংশে। ম্যানুফ্যাকচারিং খাত গত বছরের সমান হারে স্থবির, আর নির্মাণ খাতের বৃদ্ধি ১০.১ থেকে নেমেছে ৭.৬ শতাংশে।
সরকারি নথি বলছে, ত্রৈমাসিক জিডিপি হিসাব করা হয় Benchmark-indicator method ব্যবহার করে। অর্থাৎ আগের বছরের একই ত্রৈমাসিকের অনুমানকে সংশ্লিষ্ট সূচক দ্বারা বাড়ানো বা কমানো হয়। কিন্তু Annexure-B-তে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতি গত বছরের তুলনায় মন্থর।
২২টি সূচকের মধ্যে মাত্র ৫টিতে উন্নতি হয়েছে—সিমেন্ট উৎপাদন, সমুদ্রবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহণ, সরকারের রাজস্ব ব্যয় (সুদ ও ভর্তুকি বাদে), রফতানি-আমদানির ভারসাম্য এবং পুঁজি সামগ্রী। অপরদিকে, ৭টি সূচকে বড় ধরনের পতন—কয়লা উৎপাদন, ইস্পাত খরচ, ব্যক্তিগত গাড়ি বিক্রি, বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিং, রেলওয়ে যাত্রী কিলোমিটার, খনন ও বিদ্যুতের শিল্পোৎপাদন সূচক (IIP)। বাকি ১০টি সূচক মাঝারি হারে হ্রাস পেয়েছে। নতুন প্রকাশিত IIP তথ্য দেখাচ্ছে, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। ফলে দ্বিতীয়ক খাতে উচ্চ বৃদ্ধির দাবি আরও প্রশ্নবিদ্ধ।
সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো অনানুষ্ঠানিক খাতের তথ্যের অভাব। সরকারের পদ্ধতিতে তা অনুমান করা হয় সংগঠিত খাতের কিছু ডেটা থেকে—যেমন কয়েকশো তালিকাভুক্ত কোম্পানির ত্রৈমাসিক আর্থিক ফলাফল এবং IIP। কিন্তু এগুলি দেশের বিপুল ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (MSME) খাতকে কোনোভাবেই প্রতিফলিত করে না। অথচ এই খাতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা এমএসএমই কর্মসংস্থানের ৯৭.৫ শতাংশ।
ফলে, সংগঠিত খাতের আংশিক তথ্যকে ভরসা করে সমগ্র অর্থনীতির চিত্র আঁকার চেষ্টা বাস্তবতা থেকে অনেকটাই দূরে। অনানুষ্ঠানিক খাতের মন্থর গতি বা সংকট এখানে লুকিয়ে যাচ্ছে। সরকারি তথ্যপত্রে ৭.৮ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি নিঃসন্দেহে দৃষ্টি আকর্ষণকারী। কিন্তু সূচকের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়—অর্থনীতির প্রকৃত স্বাস্থ্য ততটা শক্তিশালী নয়। তৃতীয়ক খাতের সংখ্যাগত উল্লম্ফনেই ছবিটি ঝলমলে হয়েছে। অথচ অনানুষ্ঠানিক খাতের অনুপস্থিতি এবং অধিকাংশ সূচকে পতন দেশের অর্থনীতির অন্তর্গত দুর্বলতাকেই সামনে নিয়ে আসে।