শরতে কাশফুল ফুটবে, শিউলির ঘ্রাণ ছড়াবে, আনন্দময়ীর আগমন ঘটবে আর শারদ-পত্রিকা প্রকাশিত হবে না, তা কখনও হয়?
চারদিকে পুজোর সাজ সাজ রব। কর্মব্যস্ততা তুঙ্গে পুজো মণ্ডপে। একটা সময় ছিল, যখন কফি হাউস, নেতাজি কেবিন, পাড়ার কোনও দোকান, বাস-ট্রেন বা ট্রামে লোকে পুজোর বই নিয়ে আনন্দ-আলোচনায় মেতে উঠতেন। কোন পুজোবার্ষিকীতে কোন কোন বিখ্যাত লেখক, কবিরা কলম ধরেছেন, কোন লেখা এ বার পাঠক-মহলে সমাদৃত হবে— সে সব নিয়ে আলোচনা চলত। এখন মানুষ জীবনের সন্ধ্যালগ্নে নিজেকে খুঁজছেন শুধু নিজের মধ্যেই।
বাঙালির পত্রিকা-প্রীতি সময়ের প্রবাহে আজ অনেকটাই স্তিমিত। আর অবসর তো মানুষের বন্ধক রাখা মোবাইল, ল্যাপটপ, সিরিয়াল আর ট্যাবের কাছে। পাঠকও আজকাল দুই আঙুলে মোবাইল নেড়ে-চেড়ে অনলাইনে বই পড়তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তবুও আজকের অভিযোজনে স্বমহিমায় বেঁচে পুজো সংখ্যার ছাপা অক্ষরের পত্রিকাগুলি।
দুর্গাপুজো ঘিরে বিশ্বে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সব ধরণের পত্রপত্রিকার সংখ্যা আনুমানিক প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজারের মতো। তার মধ্যে কিছু বাণিজ্যিক, কিছু অ-বাণিজ্যিক আর কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত। আর তাই আম-বাঙালি আজও পুজোর বোনাসের টাকায় নতুন পোশাক, জুতো, মোবাইল, ল্যাপটপের সঙ্গে শারদীয়া পত্রিকাও কেনেন।
সম্ভবত ১২৭৯ বঙ্গাব্দ থেকে কেশবচন্দ্র সেন সম্পাদিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সুলভ সমাচার’ ইংরেজি ১৮৭২ সালে ‘ছুটির সুলভ’ নামে প্রথম শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ করে। এক পয়সায় এই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১২৮০ সালের আশ্বিন মাসে। ১৩২৫ সালে ‘পার্বণী’ নামে প্রথম বাংলা বার্ষিকী প্রকাশিত হয়। যাতে রবীন্দ্রনাথ প্রথম পুজোর লেখা দেন। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ, বঙ্গবাণী, দেশ, আনন্দবাজার এবং আরও অনেক পত্রিকা পুজোসংখ্যা প্রকাশ করতে শুরু করে।
ছোটবেলায় মা-পিসিমাদের দেখেছি শরৎকাল এলেই অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন পুজোর গান, পত্রিকা, খাওয়া-দাওয়া, জামাকাপড়, শিউলি-কাশ, মহালয়া নিয়ে। ভাদ্র মাস পড়লেই দেখেছি পুরনো রীতি মেনে বাড়ির কাপড়-চোপড়, বইপত্র সব রোদে দেওয়ার প্রথা। ঘর-দোর পরিষ্কার করার তোড়জোড়। উমা-মা আসছেন বলে কথা।
আজ সে সব অতীত।
তবে বাঙালি চিরকাল মননশীল। তা না হলে শারদোৎসব ছাড়া এত বিপুল আয়োজনে অন্য কোন ধর্মীয় উৎসবে এ রকম সাহিত্য-সম্ভার প্রকাশের নজির বঙ্গদেশ ও ওপার বাংলা ছাড়া আর কোথাও আছে বলে জানা নেই।
হাজার কবি-লেখকেরা এ ভাবেই তাঁদের লেখনী-সম্পদ ঢেলে দেন প্রতি বছর শারদীয়া সংবাদপত্র ও পত্রিকার পাতায়। এ আলো শুচি-শুভ্রতায় দীপ্ত। যার মধ্যে সাহিত্য-গুণ-সংস্কৃতির স্ফূরণ ঘটে। আজও আশ্বিন এলেই মনে আনন্দের জোয়ার এনে দেয় শারদ-সংখ্যা। চির উৎসাহে যা অবারিত পান করে যায় পাঠককুল। পত্রিকার অমৃত-সুধা। এই পত্রিকার দ্বারা মানুষের মনের মণিকোঠায় সামাজিক অনুভূতির প্রতিফলন ঘটে। লেখাগুলি তখন জ্বলজ্বল করে ওঠে মানুষের প্রেরণার উৎস হয়ে।