পুরুলিয়া-বেগুনকোদর রাজ্য সড়ক থেকে দূরত্ব মেরেকেটে এক কিলোমিটার। সেই পথে এগোলে গ্রামের মুখেই স্কুলভবন। পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ। তবে পড়ুয়ারা বসে দু’টিতে। এক শিক্ষককে দেখা গেল, কখনও এ-ঘরে ঢুকে বাংলা পড়াচ্ছেন, কখনও অন্য ঘরে দৌড়চ্ছেন অঙ্ক কষাতে।
পুরুলিয়া জেলার যে ৩৭২টি প্রাথমিক স্কুল কোনও শিক্ষক ছাড়া বা এক জন শিক্ষক নিয়ে চলছে, তারই একটি আড়শার এই হেঁটজাড়ি নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে পড়ুয়ার সংখ্যা ১৮৪। তবে শিক্ষক এক জনই— পবন দাস। গত বছরের নভেম্বরে যোগ দিয়েছেন স্কুলে। আগে দু’জন শিক্ষক ছিলেন বটে। তাঁরা অন্যত্র চলে যাওয়ায়এখন গোটা স্কুলের সব দায়িত্ব তাঁরই কাঁধে। পবনের কথায়, “প্রতিদিন গড়ে ১৩০-১৫০ জন পড়ুয়া আসে। কখনও এই ঘরে, কখনও ওই ঘরে গিয়ে পড়াতে হয়। অফিসের নথিপত্র, মিডডে মিলের বাজার করা, সব একাই দেখতে হয়। ব্লক অফিস বা অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিসে বৈঠক থাকলে বাধ্য হয়ে স্কুল বন্ধরাখতে হয়।”
একটি ঘরে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি আর অন্য ঘরে চলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পড়াশোনা। কখনও পড়ুয়া বেশি এলে তিনটি ঘরে ভাগ করে পড়ানো হয়। তখন সমস্যা আরও বাড়ে। তৃতীয় শ্রেণির কয়েক জন পড়ুয়ার কথায়, “স্যর আমাদের পড়া দিয়েই অন্য ক্লাসে চলে যান। কিছু বুঝতে সমস্যা হলেও সেই সময়ে স্যরকে পাই না। অনেক সময়ে ছুটি ছাড়াও স্কুল বন্ধ থাকে।”
এক শিক্ষকে পড়াশোনা যে কার্যত হয় না, মানছেন অভিভাবকেরাও। অক্ষয় মাহাতো, ধনঞ্জয় মাহাতোরা বলেন, “এক জন শিক্ষক অত জন পড়ুয়াকে পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। পড়াশোনার মান কেমন বুঝে নিন! সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর সাধ্য নেই। বাধ্য হয়ে এখানে পড়াচ্ছি।” পবন জানালেন, বেশ কয়েক বার জেলা শিক্ষা দফতরে স্কুলে অন্তত আর এক জন শিক্ষক বা নিদেনপক্ষে পার্শ্বশিক্ষক দিতে আবেদন জানিয়েছেন। লাভ হয়নি।
হেঁটজাড়ি শুধু নয়, এক শিক্ষক থাকা জেলার কোনও প্রাথমিক স্কুলেই পড়াশোনা কার্যত হয় না, দাবি শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ-র। তারা জানায়, জেলার জঙ্গলমহলের ব্লকগুলিতে মূলত এক জন শিক্ষক থাকা স্কুলের সংখ্যা বেশি। সমস্যা বেশি প্রকট ঝালদা ১ ও বাঘমুণ্ডি ব্লকে। সংগঠনের পুরুলিয়া সভাপতি নিলয় মুখোপাধ্যায়ের দাবি, প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলিতে শিক্ষকের ঘাটতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ, শহরাঞ্চল বা লাগোয়া স্কুলগুলিতে অতিরিক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। বিধি না মেনে শিক্ষক বদলির ফল ভুগতেহচ্ছে পড়ুয়াদের।
জেলা স্কুল পরিদর্শক (প্রাথমিক) কানাইলাল বাঁকুড়া বলেন, “শিক্ষক-সমস্যা মেটাতে পদক্ষেপ করা হচ্ছে। অবর স্কুল পরিদর্শকদের কাছ থেকে কোন স্কুলে অতিরিক্ত শিক্ষক আছেন, সে তালিকা চাওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৭ জন শিক্ষককে এক শিক্ষক থাকা স্কুলে পাঠানো হয়েছে।”